কেন বাংলাদেশ-ভারতের পেসারদের এত ফারাক?
ধ্যানমগ্ন ঋষির জীবনাচার যেমন নিয়মে বাধা, পরম নিষ্ঠায় আশ্রিত- ভারতের পেস বোলাররাও নাকি আত্মস্থ করে নিয়েছেন তেমন নিষ্ঠা, নিবেদন আর সাধনা। যার ফল দেখছে ভারতের ক্রিকেট। ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমানো পর্যন্ত, খাদ্যভাস থেকে চলাচলের প্রতিটি মুহূর্ত- তারা চলেন একটা নির্দিষ্ট খাপে।
নব্বই দশক থেকে যারা খেলা দেখেন, এতদিন ভারতীয় পেস আক্রমণ তাদের অনেকের কাছেই হয়তোবা ছিল হাসির পাত্র। নামী-বেনামী কত পেসার এসেছেন। তাদের সাফল্যের চেয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থতার কথাই স্মরণীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের আড্ডায়। জাভাগাল শ্রীনাথ বা জহির খানদের কেউ কেউ নিজেদের আলাদা করে নিতে পেরেছিলেন। পেয়েছিলেন সমীহ। কিন্তু বিশ্বসেরাদের কাতারে যাওয়া হয়নি তাদেরও।
বর্তমানে ভারতের পেস ব্যাটারির যে তেজ, তাতে এই মুহূর্তে তারাই বিশ্বসেরা কিনা এই আলাপ উঠছে। মোহাম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মা, উমেশ যাদবরা বাংলাদেশকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। চোটের কারণে খেলতে পারেননি জাসপ্রিত বুমরাহ। ছিলেন না ভুবনেশ্বর কুমারও। পাইপলাইনে অপেক্ষায় আরও অনেক নাম।
উপমহাদেশের দেশ, বাংলাদেশের মতোই সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস। তবু কী করে ভারত পেল এতসব পেস-রত্ন?
কারণ জানতে টানা দুবার রঞ্জি ট্রফির চ্যাম্পিয়ন বিদর্ভ দলের বোলিং কোচ সুব্রত ব্যানার্জিকে ফোনে পাওয়া গেল। তিনি উমেশেরও কোচ। তাকে গড়ে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে বড় অবদান তার। একসময় ছন্নছাড়া উমেশ এখন ১৪৫ কি.মি. গতিতে আগুন ঝরান। বাউন্স, মুভমেন্টে বেসামাল করেন ব্যাটসম্যানদের। সুব্রতর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছেন বরুণ অ্যারন, ইশ্বর পান্ডে আর এবার রঞ্জির ফাইনালে হ্যাটট্রিকে কাঁপানো পেস সেনসেশন রাজনিস গুরবানি।
সুব্রত জানালেন, আগে তারা খুঁজে বের করেছেন পেসারদের শক্তি আর দুর্বলতা, পরে ঠিক করেছেন এগোনোর পথ, ‘প্রক্রিয়া ঠিক ছিল। ধরেন, কার কী দরকার সেটা বুঝতে পারা একটা বড় ব্যাপার। আপনি সবাইকেই একইভাবে নার্সিং করতে পারবেন না। একেকজনের শক্তির জায়গা একেকরকম, ঘাটতির জায়গা ভিন্ন। সেটা চিহ্নিত করা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। তারপর সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করে সাজানো।’
‘ভারতে এক সময় পেস বোলিংয়ে কিছু ছিল না। হ্যাঁ, কেউ কেউ হয়তো জোরে করতে পারত, কিন্তু কীভাবে বল করতে হয়, জানত না। সেটা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আবার অনেকে জোরে বল করতে পারে না, কিন্তু স্যুয়িং-মুভমেন্ট আদায় করার ক্ষমতা আছে। তাদেরকে সেভাবে আলাদা করে নার্সিং করতে হয়েছে।’
তাতেই হয়ে গেছে! নাহ, ঘরোয়া পর্যায়ে সফল এই কোচ জানান, বেশ কয়েকবছর থেকেই চলছিল এর ভিত গড়ার কাজ। অবকাঠমোগত সুবিধা তো আছেই, তৈরি করা হয়েছে একটা সংস্কৃতি। তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পেসার হওয়ার তীব্র উৎসাহ, ‘অনুশীলন সুবিধা, শরীর তৈরি করার সুযোগ করে দেওয়া এবং প্রতিনিয়ত এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকার ব্যাপার নিয়ে নজর দিতে হয়েছে। এমআরএফ, ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি তো আছেই। প্রতিটা রাজ্য দলের মধ্যে পেস বোলিং নিয়ে সিরিয়াসনেস এসেছে। আসলে যে সংস্কৃতি ছিল না, সেই সংস্কৃতি চালু করতে হয়েছে।’
এক সময় জাতীয় দলে খেলা বাংলাদেশের ঘরোয়া এক পেসার মিরপুরের উল্টো পাশের বিরিয়ানির দোকানে মাসে বিল দেন ১৫ হাজার টাকা। শুধু এই উদাহরণ বলে দেয় খাদাভ্যাস নিয়ে কতটা নিয়ন্ত্রণহীন বাংলাদেশের পেস বোলাররা। কী খেতে হবে, কোন খাবার দূরে রাখতে হবে- তার বোধ তৈরিতেও বাংলাদেশে নেই কারও কোনো ভূমিকা।
সুব্রত জানালেন, ভারতের বয়সভিত্তিক দলেরও কোনো পেসার যদি একসঙ্গে অনেক টাকা পান, সেটা নানান রকম গ্যাজেট কেনায় খরচ না করে বিনিয়োগ করেন নিজের জীবনাচার উন্নয়নে। এই বোধটাই নাকি তারা বপন করে দিয়েছেন তাদের মনে, ‘খাদ্যাভ্যাস বদলাতে হয়েছে, একটা নিয়মতান্ত্রিক জীবনধারায় তাদের নিয়ে আসতে হয়েছে। পেস বোলিংটাও যে একটা সাধনার মতো- এটা ভেতরে ঢোকাতে হয়েছে। যারা এটাকে ধ্যান মনে করে নিমগ্ন হতে পেরেছে, তাদের কাছে আলাদা একটা মানে দাঁড়িয়ে গেছে।’
‘সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো উপভোগ করাটা। কেউ যদি কোনো কাজে মজা না পায়, প্যাশন না থাকে, তাহলে কিছু করতে পারবে না। আমাদের পেসারদের মধ্যে সেই প্যাশন তৈরি হয়েছে। এখন তারা বল করতে ভালোবাসে। যখন খেলা থাকে না তখনও একটা রুটিনের মধ্যে থাকা কেউ চাপ মনে করে না। এটাকে প্যাশন মনে করে। এই জায়গা থেকে একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে।’
ভারতীয় দলের বোলিং কোচ ভরত অরুণ বলছিলেন, তাদের পেসাররা এখন বরাবরই আগ্রাসী আর ক্ষুধার্ত। আরও বড় কিছু করতে উদগ্রীব৷ আর এমন পেস আক্রমণ থাকায় ভারত উইকেটের ধরনের কারণে কোনোরকম অস্বস্তিতে পড়ে না।
বাংলাদেশকে পেসে ভালো করতে হলে তাই আগে অবকাঠামোগত সুবিধার সঙ্গে তৈরি করতে হবে সংস্কৃতিও।
Comments