একাত্তরের নায়ক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদ
একাত্তরের গেরিলা, যদিও তিনি জনমানুষের কাছে পরিচিত নায়ক-অভিনেতা হিসেবে। বলছি রাইসুল ইসলাম আসাদের কথা। মুক্তিযোদ্ধা নায়ক আসাদ ছয়বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দেশের বাইরে ভারতীয় বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেও সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছেন। থিয়েটার দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু। বিজয়ের মাসে ৭১-এর সেই দিনগুলি নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কাছে।
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। এই শহরটাকে ভালোভাবে চিনি। এই শহরের অনেক কিছুর সাক্ষী আমি। ১৯৭১ সালের অনেক ঘটনারও সাক্ষী। কাছ থেকে অনেক কিছু দেখেছি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর আগের সময়ে পল্টনের বাসায় ছিলাম। পল্টন লাইন আমাদের বাড়ি। ১৭ বছর বয়স আমার। আমি, নাসির উদ্দিন ইউসুফ একসঙ্গেই ছিলাম। পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। ২৫ মার্চ রাতে হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পাই। তখন তো বাড়িঘর কম ছিলো এদিকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিক থেকেই আসছে গুলির শব্দ। আমরা দেখার জন্য এগিয়ে যাই। পরে জেনে যাই পাকিস্তান আর্মিরা অ্যাটাক করেছে। এরপর চলে আসি।
তারপর আরও গুলির শব্দ ভেসে আসে। চারপাশ থেকে শুধু গুলি আর গুলি। সারারাত গুলির শব্দ। কাছ থেকে না শুনলে কেউ বুঝতে পারত না কী ভয়াবহ ছিলো সেই গুলির শব্দ। এরপর চিৎকার আর চিৎকার ভেসে আসে। নির্ঘুম রাত কাটে আমাদের। এর মধ্যে কিছু পুলিশ আসেন আমাদের বাড়িতে। তারা রাইফেল রেখে যান। বলে যান আবার আসবেন, গুলি শেষ হয়ে গেছে। গুলি সংগ্রহ করতে পারলেই আসবেন। তারা আর আসেননি। আমরা এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে লেপ এনে রাইফেলগুলো ঢেকে রাখি।
২৭ মার্চ কারফিউ ছিলো। ভয়ংকরভাবে কাটতে থাকে আমাদের দিন। ওই রাতের হামলায় অনেক মানুষ মারা যায়। কী ভয়াবহ আক্রমণ তারা করেছিলো। কী জঘন্য হামলা তারা চালিয়েছিলো। ইতিহাস সাক্ষী। আমরাও সাক্ষী। ২ এপ্রিল আমি চলে যাই কেরানীগঞ্জ। সেখানেও আক্রমণ করে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। অনেক মানুষ মারা যায়। আমিসহ কয়েকজন মসজিদের ভেতরে পালিয়েছিলাম। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। মরার মতো পড়ে ছিলাম বলে বেঁচে যাই। কেরানীগঞ্জ থেকে বেঁচে যাবার পর ভাবতে থাকি কোথায় যাবো। বিক্রমপুরের দিকে চলে যাই। প্রায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই চট্টগ্রাম। আসলে এটা লম্বা কাহিনী। ছোট্ট পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না।
সেখান থেকে আমি, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, কাজী শাহাবুদ্দিন শাহজাহান চলে যাই আগরতলায়। সেটাও বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবে না। আগরতলা জার্নিটাও ছিলো অনেক কষ্টের। এক জায়গায় ব্রিজ ভাঙা ছিলো। কীভাবে যে গিয়েছি, এখন বলতে গেলে গা শিউড়ে উঠে। তখন এতো ভাবনা ছিলো না। তখন একটাই ভাবনা- ট্রেনিং নিতে হবে, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে।
আগরতলা যাবার পর মেলাঘরে ট্রেনিং শুরু হলো। সেখান থেকে কলকাতা যাই একবার। সেখান থেকে উত্তর দিনাজপুরে যাই। আবার ফিরে আসি আগরতলায় মেলাঘরে ট্রেনিং নিতে। আমরা ছিলাম ২১ জনের একটা টিম। আমরা এমনভাবে ট্রেনিং নিই, ফিরে এসে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ করবো। এভাবে এক সময় ট্রেনিং শেষ হয়। আমরা ঢাকায় ফিরে আসি। শুরু হয় দেশের জন্য যুদ্ধ। ঢাকায় গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করেছি আমরা। প্রচণ্ড দুঃসাহস না থাকলে ওই সময়ে গেরিলা আক্রমণ করতে পারতাম না।
ডিসেম্বর মানে আমার কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্যরকম দিন। ডিসেম্বরে আমরা বুঝতে পারি বিজয় আমাদের হবেই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আরও বুঝে যাই, আমাদের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। তারপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি- ১৬ ডিসেম্বর। আমরা এই দিন বিজয় অর্জন করি।
আসলে ৭১-এর স্মৃতি বলে শেষ করা যাবে না। ৭১ মানেই আজকের আমরা, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।
Comments