১২ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৭১

আজ সারা দিন কারফিউ ওঠে নি। আজো কিছু কেনাকাটা করতে বেরুবো ভাবছিলাম, তা আর হলো না। এয়ার রেইড সাইরেন অগ্রাহ্য করে রাস্তায় বেরোনো যায়, কিন্তু কারফিউ থাকলে সবাই নাচার।
Jahanara Imam
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

আজ সারা দিন কারফিউ ওঠে নি। আজো কিছু কেনাকাটা করতে বেরুবো ভাবছিলাম, তা আর হলো না। এয়ার রেইড সাইরেন অগ্রাহ্য করে রাস্তায় বেরোনো যায়, কিন্তু কারফিউ থাকলে সবাই নাচার।

যেন খুব একটা সুযোগ পাওয়া গেছে, এমন একটা ভাব করে শরীফ-জামীর দিকে চেয়ে বললাম, ‘এই সুযোগে গেস্টরুমটা গুছিয়ে ফেলি।’ ওরা রেডিও বগলে সিঁড়ির দিকে মুখ করেছিল, আমার কথায় আবার ঘুরে দাঁড়াল। ওদের নিয়ে আমি গেস্টরুমের তালা খুলে ঢুকলাম। এটা অবশ্য এখন স্টোররুম- কেউ বেড়াতে এসে হঠাৎ যাতে এ ঘরে এত জিনিসপত্র দেখে না ফেলে, তার জন্য তালা। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি সব জিনিসই এখনো ছোট ছোট চটের থলে, কাগজের ঠোঙ্গা, পলিথিনের ব্যাগে রয়েছে। তুলো, ব্যান্ডেজ, ডেটল, এস্পিরিন আরো অন্যান্য ওষুধ সব ছোট ছোট বাদামী প্যাকেটে। শরীফ সারা ঘরের ওপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এসব গুছিয়ে রাখা ঠিক নয়। এভাবেই ক্যামফ্লেজড হয়ে থাকা ভালো, হঠাৎ কেউ ঘরে ঢুকে যেন টের না পায়!’ বলেই অ্যাবাউট টার্ন করতে উদ্যত হল। আমি খুব মিষ্টি করে তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, ‘ঠিক আছে, কিন্তু এমার্জেন্সির সময় চট করে যাতে ঠিক জিনিসটি তুলে নিতে পারি, তার জন্য একটু সিজিল করে রাখা উচিত নয় কি? ধরো গুরুতর জখম একটা মুক্তিযোদ্ধাকে ব্যান্ডেজ করতে হবে, তখন যদি এই একশোটা প্যাকেটের মধ্যে তুলো খুঁজতে পনের মিনিট লেগে যায়…’

জামী একলাফে আমার পাশে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘প্রমিস করছি মা, সন্ধ্যাবেলা স-ব প্যাকেট সিজিল করে দেব। এখন তুমিও চল ছাদে, কেন কারফিউ ওঠায় নি আজ, সেটা ছাদে না গেলে টের পাওয়া যাবে না।’

আমি ভেঙচে উঠলাম, ‘তুমিও চল ছাদে! দাদাকে একা ফেলে—’

জামী বেশ সাহসী আর একটু কুটকচালে হয়ে উঠেছে আজকাল। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জড়িয়ে ধরে টেনে খাবার ঘরের দিকে নিতে নিতে গলা চড়িয়ে বলল,‘দাদা, খানিকক্ষণ একা বসে থাকুন। মাকে ওপরে নিয়ে যাচ্ছি- আলামরি খোলাতে হবে। আব্বু বাথরুমে গেছে।’ (আব্বু পাশেই দাঁড়িয়ে।)

বাবা চুপ করে খাটের পাশের ইজিচেয়ারে পড়ে রইলেন। তিনিও এ কয়দিনে বাড়ির সবার হালচাল বুঝে গেছেন। সেদিন ছেলে ও নাতিকে এয়ার রেইড প্রিকশানের কথা বোঝাতে গিয়ে নিজেই যেন অন্যরকম বুঝে গেছেন। আর কাওকে কিছু জিগ্যেস করেন না।

আমি ওদের দু’জনের সঙ্গে ছাদে গেলাম বটে, কিন্তু খানিক পরেই নিচে নেমে এলাম। বাবাকে সত্যি সত্যি তো বেশিক্ষণ একা ফেলে রাখা যায় না।

তবু বাবাকে দেখা ও রান্নার কাজের ফাঁকে ফাঁকে আজ বহুবার ছাদে গেলাম।

এয়ারপোর্টের দিকে দেখা যাচ্ছে তিনটে প্লেন বারবার করে নিচে নামার চেষ্টা করছে, আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমাদের ছাদের ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায়। জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা থেকে অপসারণের জন্য ওই চেষ্টা। কিন্তু ভারতীয় বিমান বোমা ফেলে রানওয়েটা বেশ ভালো  জখম করে রেখেছে। সকাল থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত প্রাণান্ত চেষ্টা করে প্লেনগুলো নামল, খানিক পরে উঠেও গেল। ওরা উড়ে চলে যাবার পরপরই ফটাফট দুটো বোমা রানওয়েতে মেরে দিয়ে গেল ভারতীয় প্লেনগুলো।

আরো ভালো করে দেখার জন্য সিড়িঁঘরের ছাদের টঙে জামী একবার উঠেছিল। ওখানে উঠলে এলিফ্যান্ট রোডের বুকটাও দেখা যায়। জামী নেমে এসে বলল, ‘আচ্ছা মা, সারাদিন কারফিউ অথচ এ্যাতো মাইক্রোবাস যাচ্ছে কেন রাস্তা দিয়ে? ওগুলো তো মিলিটারি গাড়ি নয়।’

Comments

The Daily Star  | English
economic challenges for interim government

The steep economic challenges that the interim government faces

It is crucial for the interim government to focus on setting a strong foundation for future changes.

9h ago