ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল যেনো ভূতের আখড়া!

‘রাত আড়াইটা থেকে বিদ্যুৎ নেই। সকাল ১০টা নাগাদও বিদ্যুৎ আসার কোন খবর নেই। সেই রাত থেকে রোগীর সঙ্গে অন্ধকারে বসে ছিলাম। পুরো হাসপাতালের ভেতরে ঘুট-ঘুটে অন্ধকার। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকসহ প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের সেবিকারা বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ কক্ষের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে কোনো আজব জায়গায় এসে পড়লাম।’
১২ ডিসেম্বর ২০১৯, আলোবিহীন অবস্থায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল। ছবি: স্টার

‘রাত আড়াইটা থেকে বিদ্যুৎ নেই। সকাল ১০টা নাগাদও বিদ্যুৎ আসার কোন খবর নেই। সেই রাত থেকে রোগীর সঙ্গে অন্ধকারে বসে ছিলাম। পুরো হাসপাতালের ভেতরে ঘুট-ঘুটে অন্ধকার। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকসহ প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের সেবিকারা বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ কক্ষের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে কোনো আজব জায়গায় এসে পড়লাম।’

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নিজের স্ত্রী’র ওয়ার্ডে রাত কাটিয়ে এমন করুণ চিত্রের বর্ণনা দিলেন জহিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার আড়াইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় রাজমিস্ত্রি জহিরুল তার প্রসূতি স্ত্রীকে গতকাল (১১ ডিসেম্বর) এই হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করেন তার স্ত্রী। সন্তান প্রসবের পর রোগীকে হাসপাতালের নিচতলার গাইনি ও প্রসূতি বিভাগে রাখা হয়।

জহিরুল ইসলাম আক্ষেপ করে এ প্রতিবেদকে বলেন, পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাসিন্দাদের চিকিৎসাসেবার সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল এই হাসপাতাল। অথচ হাসপাতালটিতে অব্যবস্থাপনার শেষ নেই। গতরাতে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো তাতে মনে হয়েছে হাসপাতালটিকে দেখভালের কেউ নেই।

শুধু জহিরুল নন, আজ সকাল নয়টার দিকে সরেজমিন গেলে এ প্রতিবেদকের কাছে আরও কিছু রোগীর স্বজন তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। তারা জানান, এ ধরনের ঘটনার মুখে রোগীদের প্রায়শই পড়তে হয়।

একই ওয়ার্ডে থাকা রাশিদা রহমান নামের এক নারী বলেন, গতরাতে মোবাইল সেটের আলো জ্বালিয়ে আমার পুত্রবধূর পাশে রাত কাটিয়েছি। গভীর রাতে রোগীর ব্যথা বেড়েছে, ব্লিডিং হচ্ছে, কিন্তু ওই সময় কোন নার্সকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। রোগী ও স্বজনরা নির্ঘুম রাত কাটালেও নার্সরা দিব্যি দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হাসপাতাল এভাবে চলতে পারে এটা গতরাতের ঘটনা যারা দেখেছে তারা ছাড়া অন্য কেউ আঁচ করতে পারবে না।

হাসপাতালের প্রশাসন শাখা সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জেলা সদর হাসপাতাল। ১৯৯৫ সালে এটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরে ২০১০ সালের ১২ মে এটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালটিতে জরুরি বিভাগ ছাড়াও মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিকস, শিশু, গাইনি ও প্রসূতি, কার্ডিওলজি, ডায়রিয়া, পেয়িং ওয়ার্ড, চক্ষু ওয়ার্ড ও বিভাগ, প্যাথলজি বিভাগ, রেডিওলোজি বিভাগ এবং অস্ত্রোপচার কক্ষ রয়েছে।

এতো কিছু থাকার পরও সুষ্ঠু তদারকির অভাবে এ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। বিদ্যুৎ চলে গেলে হাসপাতালে বিকল্প হিসেবে জেনারেটর চালু রাখার কথা। কিন্তু, প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দুটি জেনারেটরের মধ্যে একটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। নতুন জেনারেটর আনতে আবেদন করা হলেও কোনো সাড়া মিলেনি।

হাসপাতালের চতুর্থ তলায় মেডিসিন ওয়ার্ডের রোগীর স্বজন বিজয়নগর উপজেলার জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা বজলুর রহমান বলেন, হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনরা রোগীর চেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ে। ওয়ার্ডের মেঝেতে পড়ে থাকা আবর্জনার দুর্গন্ধ ও অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের কারণে তারা রোগীর চেয়ে কাহিল হয়ে পড়ে। টয়লেটগুলোতে পানি ব্যবহারের জন্য কোনো বালতি ও বদনা পর্যন্ত নেই। ফলে এর ভেতরে ঢোকার আগেই দম বন্ধ হয়ে আসে।

এদিকে হাসপাতালটিতে চিকিৎসক ও শয্যা সংকটও প্রকট। গত ২৮ নভেম্বর স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ১০ চিকিৎসকের পদোন্নতির এক আদেশ হাসপাতালে পাঠানো হলে তারা জুনিয়র কনসালটেন্ট থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত ও একই সঙ্গে বদলি হয়ে চলে যাওয়ায় এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এতে বর্তমানে এই হাসপাতালে ২১ চিকিৎসকের পদ শূন্য হয়ে গেছে। এছাড়া পাঁচটি বিভাগ চিকিৎসক শূন্য হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, তত্ত্বাবধায়কসহ এই হাসপাতালে ৫৭ চিকিৎসকের পদ রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শওকত হোসেন বলেন, “গতরাতে সারা শহরেই বিদ্যুৎ ছিলো না। ফলে হাসপাতাল অন্ধকারে ডুবে যায়। তাছাড়া হাসপাতালের দুটি জেনারেটরের মধ্যে একটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বাকি একটি জেনারেটর পুরো হাসপাতালের লোড নেয় না।”

আর চিকিৎসক সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সরকারের কাছে দ্রুত চিকিৎসক পদায়নের জন্য আবেদন করেছি।”

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

5h ago