১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭১

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে
jahanara_imam-1.jpg
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

শরীফকে বাসায় আনা হয়েছে সকাল দশটার দিকে। মঞ্জুর, মিকি- এরা  দু’জনে ওদের পরিচিত ও আত্মীয় পুলিশ অফিসার ধ’রে গাড়িতে আর্মড পুলিশ নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা পিকআপ যোগাড় করে হাসপাতাল থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন।

সকালবেলায় প্লেনের আনাগোন একটু কমই ছিল। আজ কারফিউ ওঠে নি। তবু আমাদের গলিটা কানা বলে, খবর পেয়ে সব বাড়ির লোকেরা এসে জড়ো হতে পেরেছেন। খরব পেয়ে আনোয়ার তার বোর্ড অফিসের মাইক্রোবাসটা অনেক ঝঞ্ঝাট করে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে এসেছে শেলী আর সালাম। ওই মাইক্রোবাস পাঠিয়ে মা আর লুলুকে আনা হয়েছে ধানমন্ডির বাসা থেকে। মঞ্জুর তার গাড়িতে কয়েকটা ট্রিপ দিয়ে এনেছেন বাঁকাকে, ফকিরকে, আমিনুল ইসলামকে। ডাব্লিউ. আর. খান যোগাড় করে দিয়েছেন কাফনের কাপড়।

বাড়ির পাশের খালি জায়গাটাতে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন লোক দুপুর সাড়ে বারোটায় জানাজায় শামিল হলেন। চার-পাঁচটা গাড়িতে করে জনাকুড়ি লোক গোরস্থানে গেলেন। সানু, খুকু, আর মঞ্জু আমার কাছে রইল। বাবা একেবারে নির্বাক হয়ে তাঁর ইজিচেয়ারে পড়ে রয়েছেন।

দেড়টা থেকে হঠাৎ প্লেনের কড়কড়ানি বেড়ে গেল। বারেবারে খুব নিচু দিয়ে প্লেন এলিফ্যান্ট রোড এলাকার ওপর ভীষণ শব্দ করে উড়ে যেতে লাগল। যারা গোরস্থানে গেছে তাদের জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। দুটোর মধ্যে সবাই ফিরে এলেন। জামীকে পৌঁছিয়ে আমার সঙ্গে দু’চারটে কথা বলে যে যার বাসায় চলে গেলেন। আমার দুই ভাগনী ইভা ও সুরত, জামীর বন্ধু আলী, মা আর লুলু এ বাসায় রয়ে গেল।

গত রাত থেকে কিছু মুখে তুলতে পারি নি, আলসারের ব্যথা নিয়ে নিঃসাড়ে বিছানায় পড়েছিলাম। ওধারে মা বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন, লালু বাবার হাত ধরে মৃদুকন্ঠে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। জামী এসে সামনে দাঁড়িয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে বলল, ‘মা আমার আর যুদ্ধ করা হল না।’

আমি উঠে বসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, ও কান্নার সঙ্গে চিৎকার করে হাত-মাতা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগল, ‘আমি ওদের দেখে নেব। ওরা ভাইয়াকে কেড়ে নিয়েছে, ওরা আব্বুকে খুন করেছে, ওদের ছেড়ে দেব না।’

আলী এসে জামীকে ধরে ওপাশে নিয়ে গেল, মা কান্না থামিয়ে ওর কাছে গেলেন।

হঠাৎ ভীষণ ক্কড়ক্কড় শব্দে প্লেন উড়ে গেল, মনে হল যেন আমাদের বাড়ির ছাদ ধসিয়ে দিয়ে গেল। তার পরপরই ভীষণ আর্তনাদে চারদিক ছেয়ে গেল। আমরা সবাই চকিত হয়ে উঠলাম। কি ব্যাপার! আশপাশে কোথাও বোমা পড়ল নাকি?

সকাল থেকেই বহুজনের মুখে গুজব শুনছি নিয়াজী নাকি এলিফ্যান্ট রোডের একটা হলুদ রঙের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আরো শুনছি, মোহসীন হলে, ইকবাল হলে, সলিমুল্লা হলে পাক আর্মিরা পজিশান নিয়েছে। তাই এ পাড়ায় এত ঘনঘন, এত নিচু দিয়ে ইন্ডিয়ান প্লেন উড়ছে।

একটু পরেই আমাদের দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা পড়তে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই ভয়ে শিটিয়ে গেলাম। কিন্তু তা মুহূর্ত মাত্র। ধাক্কার সঙ্গে বহু কন্ঠের কান্না ও কথার শব্দ ভেসে আসতেই আমরা সবাই দৌড়ে দরজার দিকে গেলাম। জামী দরজা খুলতেই দেখি বারান্দায় রক্তাক্ত দেহে এলিয়ে পড়ে আছে সামনের বাঁদিকের বাড়ির আকবর, ওকে ঘিরে ওদের বাড়ির সবাই- কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে মাতম করছে। ওদের পাশের বাড়ির আমির হোসেনরাও সবাই ভয়-বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়ে।

কান্না, আর্তনাদ এবং টুকরো কথার ভেতর দিয়ে ঘটনা জানা গেল। আকবরদের বাড়িতে বোমা পড়েছে। ওরা প্লেনের শব্দ শুনেই ছাদে দৌড়েছিল, বোমা পড়বে ভাবতে পারে নি। বোমার আঘাতে আকবরদের বাড়ির পেছনের অংশ এবং আমির হোসেনদের বাড়ির কোণা ধসে গেছে। দুটো ছোট ছেলেমেয়ে ছাদে মারা গেছে, আকবর গুরুতম জখম। ও বাড়ির সবাই আকবরকে তুলে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে।

জামী আর আলী রক্তাক্ত আকবরকে তুলে ভেতরে এনে ডিভানটার ওপর শুইয়ে দিল। বাকিরা কেউ সোফায়, কেউ চেয়ারে, কেউ মেঝেতে পড়ে কান্নাকাটি করতে লাগল। আমার দু’দিনের না-খাওয়া শরীরে কোথা থেকে জোর এল জানি না। বাড়িতে তিনজন সদ্য পাস করা ডাক্তার ইভা, সুরত ও খুকু। আমি ওদেরকে বললাম, ‘তোরা প্রথমে দেখ কার কতটা জখম হয়েছে। আমি মেডিক্যালে ফোন করেছি এম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য।’ ভাগ্যক্রমে একবার ডায়াল করেই মেডিক্যাল হাসপাতাল পেয়ে গেলাম। বাসার ঠিকানা ও ডিরেকশান দিয়ে এম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলাম।

আকবার ছাড়াও দু’চারজনের জখম বেশ গুরুতর। যারা  জখম হয় নি তারাই বেশি কান্নাকাটি করছে। এক শিশি ভ্যালিয়াম-টু ইভার হাতে দিয়ে বললাম, ‘প্রত্যেককে পাইকারি হারে দুটো করে খাইয়ে দাও। ওদের একটু শান্ত হওয়া দরকার। খুকু তুমি পানির জগ আর গ্লাস নাও।’

ভ্যালিয়াম খাওয়ানো শেষ হলে খুকু, ইভা, সুরতকে কিছু তুলো, আয়োডিন, ডেটল, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি দিয়ে বললাম, ‘যতটা পার ফার্স্ট এইড দাও।’

সাড়ে চারটে বাজে। আরেকটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। আমি, আমির হোসেন, বাবলু, সাজ্জাদ ও আরো কয়েকজনকে বললাম, ‘তোমরা প্লেনের শব্দ কমলেই দৌড়ে বাড়ি গিয়ে রান্নাকরা খাবার, বাচ্চার দুধের টিন, চালের টিন, আটার টিন, এক এক করে নিয়ে এসো। রাতে মেঝেয়  শোয়ার মত লেপ-তোষকও নিয়ে এসো।

গেষ্টরুমের তালাটা ঠিকমত লাগানো আছে কিনা, একফাঁকে দেখে এলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে রসদ জমিয়েছি, তা কিছুতেই এখন খরচ করব না। তাছাড়া ওদের ঘরে তো আছেই। ওগুলো নষ্ট করার দরকার কি?

পাঁচটার সময় এম্বুলেন্স এল। আকবরসহ বাদবাকি আহত সবাই এবং তাদের দেখাশোনার জন্য সুস্থ কয়েকজন এম্বুলেন্সে চড়ে মেডিক্যাল হাসপাতালে চলে গেল।

দশ মিনিট পরেই আরেকবার ভীষণ শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। এবার মনে হল আমাদের পেছন দিকের গলিতে বোমা পড়েছে। ফট করে কারেন্ট চলে গেল। ফোন তুলে দেখি ওটাও ডেড! ব্যস, এবার ষোলকলা পূর্ণ হল। ফ্রিজ চলবে না, পানির পাম্প চলবে না। কেরোসিন ফুরোলে ইলেকট্রিক হিটার দিয়ে কাজ সারা যাবে না। কারফিউর সময় ফোনটাই ছিল একমাত্র যোগসূএ। সেটাও গেল। এখন সত্যি সত্যি কবরখানা।

সারা মেঝেজুড়ে বিছানা পাতা হয়েছে। সিঁড়ির ঠিক নিচে খাটে প্রথমে বাবা, তারপর জামী ও আলী। নিচে মেঝেয় খাট ঘেষে আমি, ইভা, সুরত, মা, লালু। আমাদের পরে প্রথমে আকবরের ভাবীর মেয়েরা, তারপর ওদের বাড়ির পুরুষেরা। ওদের পরে আমির হোসেনদের বাড়ির পুরুষেরা, তারপর ওদের বাড়ির মেয়েরা। ওদের বিছানা ঘরের ওপাশের দেয়ালে খাবার টেবিলের পা পর্যন্ত গেছে।

রাত দুটোর সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কারা যেন ডাকাডাকি করছে জামীর নাম ধরে। উঠে টর্চ জ্বালালাম, জামী জানালার কাছে গিয়ে একটা পাল্লা খুলল। আমাদের বাড়ির একদম নাক বরাবর সামনের বাড়ির হোসেন সাহেবের গলা। ওঁদের পেছনের বাড়ির কোণায় আগুণ জ্বলছে। কি করে আগুন ধরেছে কে জানে। কিন্তু এখন যদি ওপর থেকে দেখে কোন প্লেন বোমা ফেলে?

আমি বললাম, ‘জামী, আলী, বাবলু আর সাজ্জাদ তোমারা গরম জামা পরে নাও। হোসেন সাহেবের বাড়ির ছাদে উঠে দেখবে কিভাবে আগুনটা নেভানো যায়।’

মা’র গলা শোনা গেল, ‘এরমধ্যে আবার জামী কেন? ও ছোট ছেলে, ওর যাবার দরকার নেই।’ বাবুল সায় দিল ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, জামীর যাবার দরকার নেই।’ আমি ধমকের সুরে বললাম, ‘না জামী অবশ্যই যাবে।’

আমি গেস্টরুম থেকে মোটা দড়ির একটা বান্ডিল আর মাঝারি একটা বালতি এনে রাখলাম। ওরা গরম কাপড় পরে দড়ি-বালতি নিয়ে হোসেন সাহেবের বাড়ি গেল।

আরও পড়ুন:

১৩ ডিসেম্বর, সোমবার, ১৯৭১

১২ ডিসেম্বর, রবিবার, ১৯৭১

Comments

The Daily Star  | English

SWISS Banks: Funds linked to Bangladesh hit 3-year high

Bangladeshi-linked funds parked in Swiss banks surged to 589.5 million Swiss francs, or about Tk 8,800 crore, in 2024, their highest level in three years, according to data released by the Swiss National Bank (SNB) yesterday.

8h ago