টেলিকম-আইসিটি সহযোগী, না প্রতিদ্বন্দ্বী

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ উদযাপিত হলো গত ১২ ডিসেম্বর। নামটাকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ ধরলে এটি দ্বিতীয় আয়োজন। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো ১২ ডিসেম্বরকে জাতীয় আইসিটি দিবস হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু, একটি আয়োজনের পরের বছরই সেটি হয়ে যায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ উদযাপিত হলো গত ১২ ডিসেম্বর। নামটাকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ ধরলে এটি দ্বিতীয় আয়োজন। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো ১২ ডিসেম্বরকে জাতীয় আইসিটি দিবস হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু, একটি আয়োজনের পরের বছরই সেটি হয়ে যায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অষ্টম জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণা করেছিলেন। সেই উপলক্ষকে ধরেই আসল ‘আইসিটি দিবস’ এবং পরে হলো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’।

গত বছর জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক ডামাডোলের ব্যস্ততায় কেউ বুঝতেই পারেনি কোথা থেকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ আসলো আর কোথাই বা সেটা গেলো। কিন্তু, এবার চমৎকার জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে পালিত হলো দিনটি। ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে গেলো চারদিক। বর্ণিল র‌্যালি হলো, ইতিবাচক আলোচনা হলো, কনসার্ট হলো, আলোকসজ্জা হলো। সবকিছু মিলে দিনটি খুব একটা উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হলো।

উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে নানা আয়োজনে ঠাসা ছিলো দিনটি। কিন্তু, এতোসব আয়োজনের মধ্যেও খুঁতখুঁতে একটা দাগ কিন্তু ধরা পড়লো চোখে।

এত্তোসবের মধ্যেও যে বিষয়টি কারো দৃষ্টি এড়ায়নি সেটি হল– দিনটি পালন কেন্দ্রিক এই আয়োজনে সরকারের একই মন্ত্রণালয়ের মধ্যেও বিপরীতমুখী চেহারা।

বলছি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কথা। খুব স্বাভাবিকভাবেই দিনটি পালনের ক্ষেত্রে তাদেরই নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু, গোল বাঁধলো- ‘নেতৃত্ব দেবেন কে?’- তা নিয়ে। একদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, আরেক দিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-বিভাগ। একটি বিভাগের নেতৃত্বে একজন মন্ত্রী আরেকটির নেতৃত্বে প্রতিমন্ত্রী।

টেলিযোগাযোগ এবং আইসিটি’র এই বিপরীতমুখী অবস্থান কিন্তু শুধু আজ নয়, এটি একটি পুরনো চিত্র। দুটি আলাদা মন্ত্রণালয়কে ভেঙে যখন একটি মন্ত্রণালয় করা হলো তখন থেকেই তারা সহযোগীর বদলে প্রতিযোগীর ভূমিকায় চলে গেলো। ভুরি-ভুরি উদাহরণ আছে। যার অনেকগুলো আবার বিব্রতকরও।

দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে দুই বিভাগ শুধু পৃথক পৃথক আয়োজন করেই ক্ষান্ত হননি। এমনকী, দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্যও নিয়েছেন তারা। আইসিটি নিয়েছে ‘সত্য মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে’ আর টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘সংযুক্তিতে উৎপাদন, দেশের হবে উন্নয়ন’।

একটি জাতীয় দিবসের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্যের কথা কেউ কখনো শুনেছেন কী না জানা নেই। সম্পর্ক বোঝাতে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারতো?

এই সেক্টরের খোঁজ-খরব যারা রাখেন তারা ভালো করেই জানেন অনেক দিন থেকেই একই মন্ত্রণালয়ের হয়েও দুই বিভাগ দুই দিকে তাকিয়ে পথ চলছে। গুগল ম্যাপ বলছে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের মধ্যে দূরত্ব নয় কিলোমিটারের কম। একটি বাংলাদেশ সচিবালয়ে; অন্যটির অবস্থান আগারগাঁওয়ের আইসিটি ভবনে। কিন্তু, বাস্তবিক দূরত্ব তো যোজন-যোজন।

অথচ কে না জানে, এগিয়ে থাকা পৃথিবীর কোথাও আর এখন টেলিকম এবং আইসিটিকে আলাদা করে বিবেচনা করা হয় না। এমনকি আমাদের আশপাশের দেশেও এটি আর আলাদা করে বিবেচনা করার বিষয় নয়। বরং এরা একই সুতোয় গাঁথা। টেলিকম পুরোপুরি আইপি’র ওপরে চলে গেছে। আবার উল্টো করে বললে আইসিটি মানেই আর এখন কেবল কম্পিউটার বা ল্যাপটপ-ইন্টারনেট নয়। আইসিটির পুরো সেবা এখন হাতের মোবাইল ফোনে। এই জিনিসটা সবাই বোঝেন, বুঝি না শুধু আমরা। সে কারণেই আমরা সহযোগীর বদলে হয়ে উঠি আক্রমণাত্মক বিপক্ষ।

এমন অনেক অনুষ্ঠানই কাভার করার সুযোগ হয়েছে যেখানে দেখেছি মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী প্রধান অতিথি আর বিশেষ অতিথি। বিশেষ অতিথি তার বক্তব্য শেষ করেই ‘বিশেষ কাজ’ থাকায় বেরিয়ে যাচ্ছেন। একবার এমনটা হলে কথা ছিলো। কিন্তু, যখন দফায়-দফায় ঘটে তখন কানার বাবা অন্ধেরও কি বুঝতে বাকি থাকে- কী হচ্ছে এসব?

২০১৩ সালে সরকার ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে নাম দেয় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। খুবই ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথম মন্ত্রী ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। অল্পদিনের মধ্যেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে বরখাস্ত হন তিনি। তারপর দু’জন প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে চালিয়েছেন বিভাগ দুটি। প্রধানের তত্ত্বাবধানে থেকেও তারা সহযোগী হলেন না। এমনকী, তাদের মুখ দেখা-দেখিও ছিলো না। এমনও হয়েছে, একজন একটি বিশেষ-সেবা চালু করার জন্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে একটি শর্টকোডের আবেদন করেছেন তো আরেকজন সেটি বাতিল করতে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন।

অনেকবারই তাদের মুখ থেকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মতো কথাবার্তা চলে আসতো। অবশ্য সব-ই ছিলো ‘অফ দ্য রেকের্ড’। তাই মিডিয়ায় সেগুলো আসেনি। মন্ত্রণালয় একটি হওয়ায় সংসদীয় কমিটিতে বাধ্য হয়েই তাদের দেখা হতো। কিন্তু, সেখানেও একজনের কাজ নিয়ে আরেকজন হরহামেশাই অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগের প্রমাণ সংসদীয় কমিটির বৈঠকগুলোর কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ আছে। ঠেলাঠেলির ধাক্কায় তো একজনের দপ্তরই বদলে গেলো।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পুরো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে শুরু করলেন মন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রী থেকে গেলেন আইসিটি বিভাগে। কিন্তু, তখনও ঠেলাঠেলি আর রেষারেষি ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ওইসময় এগারো মাসের মেয়াদে প্রতিমন্ত্রী বলতে গেলে তার দপ্তরেই বসেননি। অনেকে বলেন, তাকে বসতে দেওয়া হয়নি।

অথচ কী ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই না দুই মন্ত্রণালয়কে একত্রিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ কেবল পালন নয়, বরং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের গতি তরান্বিত করতেই নিশ্চয় দুটি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করা হয়েছিলো।

অবশ্য একথা শুনলে অনেকেরই আর এখন ভালো লাগবে না যে, গত জরুরি অবস্থার সরকারই প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলো কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে একত্রিত করার। তখন আইসিটি আলাদা মন্ত্রণালয় নয়। সেটি ছিলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায়। নাম ছিলো ‘বিজ্ঞান ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়’। মহাজোটের নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকার এটিকে ভেঙে আলাদা দুটি মন্ত্রণালয়- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় করে।

জরুরি অবস্থার সরকারের সিদ্ধান্ত ছিলো ডাক ও টেলিযোগাযোগ, আইসিটিসহ বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং তথ্য মন্ত্রণালয়– অর্থাৎ তিনটি মন্ত্রণালয়কে একত্রিত করে একটি মন্ত্রণালয় করা। এই প্রস্তাব সেসময় এসেছিলো বিটিআরসি থেকে। ব্যাখ্যা হিসেব বলা হচ্ছিলো, তথ্যপ্রবাহ যেদিকে যাচ্ছে তাতে সেটিও টেলিযোগাযোগ বা আইসিটি’র অঙ্গীভূত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আজ ১১ বছর পরে এসে কিন্তু মনে হচ্ছে- ঠিক-ই তো, সবতো একদিকেই যাচ্ছে। জরুরি সরকারের প্রস্তাব যে ঠিক ছিলো তা প্রমাণিত হয়েছে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মহাজোট প্রথমে বিজ্ঞান থেকে আইসিটিকে আলাদা করলো এবং পরে ২০১৩ সালে টেলিকম এবং আইসিটিকে একীভূত করলো। দাপ্তরিকভাবে তো সিদ্ধান্তটাকে ভালোই দেখাচ্ছে। কিন্তু, সরকারের এই সিদ্ধান্ত হৃদয়ঙ্গম করে ডিজিটালাইজেশনকে নেতৃত্ব দেবেন কে? তারা যে দুই পথের যাত্রী!

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago