‘এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বড় বন্ধুরাষ্ট্র’
ভারতের অন্যতম প্রধান ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’র এডিটর-ইন-চিফ শেখর গুপ্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে এক ভিডিও বক্তৃতায় দেশ দুটির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেছেন যে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি মানুষের ভারতে চলে আসার কোনো কারণ নেই।
গত ১২ ডিসেম্বর গণমাধ্যমটির ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বড় বন্ধুরাষ্ট্র।
শেখর গুপ্ত যা বলেছেন:
আমরা আজকে কথা বলবো বাংলাদেশ নিয়ে। এছাড়াও, থাকবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের প্রভাব।
আলোচনায় দুটি প্রসঙ্গ আসবে। একটি হলো: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের দিল্লি আসার কথা ছিলো। গুরুত্বপূর্ণ ‘দিল্লি ডায়ালগ’-এ তার অংশ নেওয়ার কথা ছিলো। তিনি তার সফর বাতিল করেছেন বিশেষ ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে।
কিন্তু, বিষয়টিকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, ভারতের সংসদে যা চলছে তা আব্দুল মোমেনের জন্যে অস্বস্তিকর হতে পারে।
দ্বিতীয়টি হলো: বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের শিলং সফর বাতিল প্রসঙ্গ। সেখানে ফ্রিডম ফাইটারর্স ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অনুষ্ঠানে তার যোগ দেওয়ার কথা ছিলো। উত্তরপূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলো, বিশেষ করে, শিলংয়ে সহিংসতা চলার কারণে তিনিও সফর বাতিল করেছেন।
এসব ঘটনা সমস্যা তৈরি করছে। কারণ, বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আর যদি বিভিন্ন ঘটনাবলী বিবেচনা করা যায়, তাহলে বলবো- এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুরাষ্ট্র।
অপর প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র নেপালের সঙ্গে ভারতের বর্তমান সম্পর্ক যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো, নেপালি সরকার ভারতের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন রয়েছে। তারা ঝুঁকছে চীনের দিকে।
শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার পরিচিত চীনপন্থি হিসেবে। সেখানে রাজাপাকসেরা আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। মালদ্বীপের বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন না হলেও এর আগের সরকার ভারতের প্রতি বিরূপ ছিলো। যাহোক, মালদ্বীপের ভৌগলিক দূরত্বে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ডামাডোলে দ্বীপ দেশটির ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের খাঁটি বন্ধুরাষ্ট্র। দেশ দুটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এতো গভীর যে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকার সীমান্ত সমস্যা সমাধান করেছে। দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক এতোই গভীর যে তারা জল-স্থল সীমান্ত সমস্যা দূর করতে পেরেছে। অথচ, নেপালের সঙ্গেও ভারতের সীমান্ত-বিরোধ রয়েছে।
সেই হিসাবে বাংলাদেশ হলো একমাত্র দেশ যার সঙ্গে ভারতের সীমানা ইস্যু নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
এছাড়াও, সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের আন্তরিক বন্ধু। বাংলাদেশ তার মাটি থেকে আইএসকে নির্মূল করার পাশাপাশি আসামের সশস্ত্র সংগঠন উলফার নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রতি খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে।
কিন্তু, এসময় এই সুসম্পর্ককে ভারত নষ্ট করতে পারে না। ভারত সরকার নাগরিকত্ব আইন নিয়ে যে খেলা খেলছে তাতে দেখা যাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়েছে। কারণ, ভারতের সংসদে অমিত শাহ বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটিতে রয়েছে বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থান। রয়েছে প্রায় ২ কেটি হিন্দু ধর্মাম্বলী যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ।
অমিত শাহ সংসদে বলেছেন, ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ছিলো ২২ শতাংশ এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে। তার মতে, সেখানে সংখ্যালঘুদের হত্যা করা হয়েছে। জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। অথবা, ভারতে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। একটি বন্ধুরাষ্ট্র সম্পর্কে এই কথা বলা কঠিন কাজ। নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশকে কষ্ট দিয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ হচ্ছে ধর্মভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র। কিন্তু, আফগানিস্তানের সরকার বলছে, তাদের দেশে সংখ্যালঘুরা ভালো রয়েছে। দেশটিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। তারপরও আফগানিস্তানকে ধর্মভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র বলা ঠিক না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন বিশেষণ ব্যবহার করা ভুল।
কেননা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে। জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের আমলে সেই পথ থেকে দেশটি খানিকটা সরে গেলেও অর্থাৎ, তারা বাংলাদেশকে ইসলামীকরণের জন্যে কাজ করলেও পরবর্তীতে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে জেনারেলদের জারি করা সামরিক আইনগুলোকে অকার্যকর করে দেন। তিনি সামরিক শাসনকে অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে সামরিক শাসকদের আইনগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কোনোভাবেই তা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। এটিই হচ্ছে লক্ষণীয় বিষয়। এটি প্রশংসার দাবি রাখে।
কেউ যদি মনে করেন ভারত বিপুল সমৃদ্ধশালী দেশ আর বাংলাদেশ হচ্ছে চরম দরিদ্র- তাহলে কিন্তু ভুল হবে। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে ভারতে থেকে এগিয়ে রয়েছে। এখন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১ শতাংশ আর ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছে। তাই যারা ভাবছেন- বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ ভারতে চলে আসছে তারা ভুল করছেন।
ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনার দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ কাজের জন্যে ভারতে যাওয়ার চেয়ে ইতালিতে যেতে বেশি পছন্দ করবে। তারা সাগরে লাফ দিয়ে সাঁতার কেটে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করবে। অভিবাসনের জন্যে ইউরোপ তাদের পছন্দের স্থান। ভ্যাটিকান শহরেও অনেক বাংলাদেশিকে দেখা যায় রাস্তায় পণ্য বিক্রি করছেন। তার প্রশ্ন- বাংলাদেশিরা কেনো ভারতে যাবে? ভারতে গিয়ে তারা কী সুবিধা পাবে?
বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, দেশটির নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ১,৫৬৩ মার্কিন ডলার। ভারতের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ১,৯৮১ ডলার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের ১,৫৬৪ ডলার এবং আসামের ১,২৯৮ ডলার। এই যখন অবস্থা তখন বাংলাদেশিরা কেনো দল বেঁধে আসামে আসবে? পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।
এছাড়াও, বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু যেখানে ৭২ দশমিক ৫ বছর, সেখানে ভারতের জনগণের গড় আয়ু ৬৯ বছর। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীদের অবস্থান ৩৩ শতাংশ আর ভারতে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর দ্বারাও বোঝা যায় বাংলাদেশে ইসলামভীতির কোনো ভিত্তি নেই।
ভারতে জন্মহার যেখানে হাজার প্রতি ২০ দশমিক ২ সেখানে বাংলাদেশে জন্মহার হাজারে ১৮। শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে হাজার প্রতি ৩১ দশমিক ৭ এবং ভারতে ৪১।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮ এবং ভারতের অবস্থান ১০২ এ।
অথচ বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি মানুষ ভারতে এসেছে, ভারতের অর্থনীতি ভালো বলে বাংলাদেশ তার নাগরিকদের দায়ভার ভারতের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গত ৪০ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের কাছাকাছি। তাহলে এই কোটি কোটি মানুষ কোথায় গেলেন? গত ৩০ বছরে দুই দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং ভারতের ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে সাফল্যের গল্প। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নেতিবাচক মন্তব্য করা ঠিক না। এর তিনটি কারণ রয়েছে। এক, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে। দুই, এটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এর জন্ম হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে এবং বর্তমানে এটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
আর সর্বশেষ কারণ হলো: বাংলাদেশকে শ্রদ্ধা করা উচিত। কেননা, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বড় বন্ধুরাষ্ট্র। মনে রাখতে হবে, চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্যে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। চীন চাইছে বাংলাদেশকে ভারতের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে। সেই পাঞ্জাবি প্রবাদটি মনে রাখতে হবে- ‘কাবুলে চুলা জ্বালালে মুলতানে আগুন জ্বলে’।
শেখর গুপ্ত, এডিটর-ইন-চিফ, দ্য প্রিন্ট
Comments