স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

তিনি বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছিলেন

স্যার ফজলে হাসান আবেদকে যারা চিনতেন তারা তাঁকে ভালোবেসে আবেদ ভাই বলে ডাকতেন। বাংলাদেশে যখন ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আঘাত হানে তখন তিনি মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন। সম্প্রতি, আলাপকালে আবেদ ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়ে তামারা জানান, ঘূর্ণিঝড়টি যখন আঘাত হানে তখন তিনি অর্ধচেতন অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় আক্রান্তদের উদ্ধার করার জন্য কী কী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং ব্র্যাক কীভাবে শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে অসংলগ্নভাবে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলগুলো পুনর্নির্মাণ বিষয়ে।

দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিলো এমনই।  

তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথোপকথন ছিলো অল্প কয়েক মিনিটের। তিনি শোয়া অবস্থায় ছিলেন এবং বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা, ডেইলি স্টার কেমন করছে সে সম্পর্কেও কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন আশা না হারাতে, হাল না ছাড়তে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনি বাংলাদেশের মানুষের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশের প্রথম দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, কাগজটি গণমুখী সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিকশিত হওয়ায় তিনি আনন্দিত।

আমি তাঁর কাছ থেকে ধীরে ধীরে চলে আসার সময় চুপি চুপি তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম আরও বেশিক্ষণ থাকা যায় কী না। আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে আমি আর কখনও তাকে তাঁর মার্জিত পোশাকে দেখতে পাবো না। তাঁর স্বভাবসুলভ শান্ত, আশ্বাসপূর্ণ, উত্সাহব্যাঞ্জক এবং অনুপ্রেরণামূলক কণ্ঠটি আর শুনতে পাবো না। সেই গভীর হতাশাবোধ দ্রুত এসে আমার মধ্যে ভিড় করে।

দরিদ্রদের সেবা করা কেনো জরুরি, কেনো দারিদ্র্য হ্রাস করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেনো শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মূলমন্ত্র, এগুলো থেকে কোনোভাবেই দৃষ্টি না সরানো- বিষয়গুলো মনে পড়তে লাগলো। চলে আসতে আসতে তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম যে আমি একজন কিংবদন্তিকে পিছনে রেখে যাচ্ছি। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন এবং আন্তরিকভাবে দেশ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সবার অনুপ্রেরণার ঝর্ণাধারা।

দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এস এম আলীর সঙ্গে আমি ১৯৯২ সালের কোনো একসময় আবেদ ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। সাক্ষাৎকারে তিনি একটি আকর্ষণীয় মন্তব্য করেছিলেন যা আজও আমার মনে গেঁথে রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা অনেকেই বিভিন্ন পর্যায়ের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করি। বাংলাদেশের গরীব নারীরাই দরিদ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে, এবং এটা এমনভাবেই করে যে, অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তারা পুরুষদের থেকে অনেক ভালো ব্যবস্থাপক।

অভাব অনটনের সংসার পরিচালনা করার প্রায় পুরো দায়িত্ব পালন করেন পরিবারের নারী সদস্যরা। তাদের যাকিছু সামান্য অর্থ থাকে তা দিয়েই তাদেরকে সন্তানের পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, খাদ্য- সবকিছুই ব্যবস্থা করতে হয়। আমাদের নারীদের মন সমসময়ই এই চিন্তায় মগ্ন থাকে যে হাতে যা রয়েছে তা দিয়েই পরিবারটিকে চালিয়ে নিতে হবে, এগিয়ে নিতে হবে।

একটি দরিদ্র পরিবারের পরিচালক, পরিকল্পনাকারী ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবে একজন নারীর ভূমিকা সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিতেন আবেদ ভাই। আমাদের উন্নয়নকাজে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার অন্তর্দৃষ্টি তিনি আমাকে এভাবেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। দরিদ্র পরিবারের একজন নারীর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অসাধারণ সক্ষমতা থাকে। তিনি জানেন তার হাতে কী  আছে এবং তা দিয়েই তাকে সংসার চালাতে হবে। এই আত্ম-উপলব্ধি নারীকে তার সংগতির চেয়ে আরও বেশি দক্ষ করে তোলে। মূলত এ কারণেই ক্ষুদ্র ঋণ পরিশোধের হার প্রায় ৯৯ শতাংশ (আমাদের অভিজাত ঋণগ্রহীতাদের ঋণখেলাপির সঙ্গে এটি তুলনা করুন)। কারণ ঋণগ্রহীতাদের অধিকাংশই নারী।

আবেদ ভাই অত্যন্ত উচ্চতর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। তিনি বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছিলেন। বিষয়টি এমন যেনো এটিই তাঁর করার কথা ছিলো। ব্র্যাক বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়েছে এবং প্রায় দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিলো। তিনি একটি বিশাল অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। যার আওতায় এক সময় ৬৩ হাজার স্কুল পরিচালিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত বৃহত্তম টিকাদান কর্মসূচি, আইসিডিডিআরবির সহযোগিতায় খাওয়ার স্যালাইন প্রকল্প, হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি তাঁর বড় স্বপ্নগুলোরই অংশ। ব্র্যাকের কাজ শুরু করতে গিয়ে তিনি জেনেছিলেন এ দেশে শিশু মৃত্যুর হার বেশি তার প্রধান কারণ ডায়রিয়া। যে দেশে শিশু মৃত্যুর হার বেশি সে দেশে জন্মহারও বেশি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। ফলে ডায়রিয়া প্রতিষেধক খাবার স্যালাইন প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছেছিলো ব্র্যাক। একটি সুসংগঠিত সংস্থা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলো। এই প্রকল্পের সাফল্য তার আত্মবিশ্বাসে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলো। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বড়-স্বপ্ন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সক্ষমতা তার প্রতিষ্ঠানের তৈরি হয়েছে এবং তিনি আরও বড় পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারবেন। খাবার স্যালাইন প্রকল্পের সাফল্য আবেদ ভাইয়ের চিন্তাজগতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিয়েছিলো। এটিকে ব্র্যাকের আসল জন্ম হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।

কেউ কি কখনও ভেবেছিলেন যে বিশ্বের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া দেশটি এক সময় অন্য দেশকেও সহায়তা করবে? ব্র্যাক এখন ১২টি দেশে কাজ করে এবং আরও অনেককে প্রযুক্তিগত এবং অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকে। ব্র্যাকের অগ্রগণ্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মডেলটি এখন বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে নানাভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

যেহেতু তিনি বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি জানতেন প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে না পারলে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে, তারা খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবেন না। এই ভাবনাই তাকে প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং একজন দক্ষ পরিচালকে পরিণত করেছিলো। ব্র্যাক ব্যাংক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউশন অফ গভর্নেন্স এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এর কয়েকটি উদাহরণ। তিনি ডেল্টা-ব্র্যাক হাউজিং, বিকাশ, গার্ডিয়ান ইন্স্যুরেন্সের অংশীদার ছিলেন। ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’সহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে নীরবে কাজ করেছেন। অনেক সামাজিক সংস্থা প্রতিষ্ঠায় তিনি সহায়তা করেছিলেন। তিনি আরও অনেককে তাদের নিজস্ব সংস্থা প্রতিষ্ঠাতেও সহায়তা করেছিলেন।

প্রতিষ্ঠান তৈরি ও টিকে থাকার মূল বৈশিষ্ট্য হলো আর্থিক সক্ষমতা। আবেদ ভাইয়ের তৈরি সব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী। ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, যা কেবল এ বছরেই ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে এবং তা নির্বিঘ্নে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, সোরোস ফাউন্ডেশন, মেলিন্ডা এবং বিল গেটস ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য অনেক দাতাসংস্থার চেয়ে আবেদ ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলো আক্ষরিক অর্থে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই প্রসারিত হচ্ছে। এর কারণ, আবেদ ভাইয়ের পরিচালন-দক্ষতা এবং সেই দক্ষতা তিনি কর্মীদের ভেতরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ব্র্যাকের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ডিএফআইডি একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে যা অনন্য।

একজন অত্যন্ত দক্ষ পরিচালক হিসেবে তিনি ঠিক জানতেন কোথায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে, কোথায় শক্ত হতে হবে এবং কোথায় নমনীয় হতে হবে, কোথায় শুনতে হবে এবং কোথায় গ্রহণ করতে হবে, এবং কোথায় শুনতে হবে এবং কোথায় উপেক্ষা করতে হবে।

তিনি তাঁর কাজ এবং নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ব্র্যাকের বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রমকে কীভাবে আরও গতিশীল করা যায় সে সম্পর্কে গবেষণার জন্য বিশ্বমানের পরামর্শদাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা এসেছেন, বেশ কয়েকবার আমার সঙ্গে তাদের দেখাও হয়েছে।  প্রায় ২০ বছর আগে আমার কথা হয়েছিল, ব্র্যাকে আবেদ ভাইয়ের উত্তরসূরি পরিকল্পনা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরামর্শদাতাদের সঙ্গে। কোনো সহযোগিতা করতে পারিনি তবে এই লোকটির দীর্ঘমেয়াদী দর্শনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।

স্যার ফজলে হাসান আবেদের বহুমুখী প্রতিভার প্রমাণ এই যে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপী পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সেই ক্ষেত্রগুলো হলো- শিক্ষা, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং নারীর ক্ষমতায়ন। উপরের যেকোনো একটি ক্ষেত্রে কাজ করতে যেকোনো মেধাবী মানুষের সারাজীবন লেগে যায়। সমাজ বদলানোর ইতিহাসে দেখা যায় খুব কম মানুষই আছেন যারা উন্নয়নের এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর প্রতি বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন এবং তাদের অসাধারণ অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর উচ্চতর দূরদর্শিতা, সাহস এবং দৃঢ়চেতা মনোভাব- সঙ্গে মৌলিকত্ব এবং ব্যবস্থাপনার দক্ষতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নেতৃত্ব গুণাবলীর এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা গর্বিতভাবে তার ছায়াতলে দাঁড়িয়ে আছি।

Engilish version: Tribute To Sir Fazle Hasan Abed: He dreamt big and made them come true

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

8h ago