দেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসারে ভাটা
বিদ্যুতায়নে সরকার গত দুই বছরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে যে তৎপরতা দেখিয়েছে, তাতে কমে গেছে সৌরবিদ্যুতের প্রসার।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে ৪৩ দশমিক ২৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন হয়েছে যা আগের বছরের তুলনায় শতকরা ১৯ ভাগ কম।
সর্বোচ্চ ৫৭ দশমিক ৭৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের কাজ হয়েছিলো ২০১৭ সালে। “সারাদেশে যেহেতু শতভাগ বিদ্যুতায়ন হচ্ছে, বিদ্যুৎবিহীন (অফগ্রিড) এলাকা বলে কিছু থাকছে না। আগের বছরগুলোতে সোলার হোম সিস্টেমের ব্যবহার বেশি ছিল,” বলেন, স্রেডা চেয়ারম্যান মো. হেলাল উদ্দিন।
“বিদ্যুৎ-সংযোগের বাইরে কেউ থাকবে না। সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আমরা কাজ করছি”, যোগ করেন তিনি।
২০২১ সালের মার্চের মধ্যে সরকার এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সে লক্ষ্যে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ জোরেসোরে চলছে। আর তাতে মানুষের সৌরবিদ্যুতের প্রতি আগ্রহ কমেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৬০ লাখ বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে।
২০১৭ সালের জুনের দিকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল দেশের ৩৯ শতাংশ জনগণ। বর্তমানে তা বেড়ে ৯৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত দেড় বছরে নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগের সম্প্রসারণে আরো ৬০ লাখ নতুন গ্রাহক যোগ হয়েছে।
কিন্তু, যখন সারাবিশ্ব নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে এবং তার জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণায় বিনিয়োগ করছে, ঠিক তখনই আমাদের সৌরবিদ্যুতের প্রসার থমকে যাওয়ার মুখে।
আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত এক দশকে সারাবিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১৭১ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন প্রতি বছর ৭ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ৮৪ শতাংশই আসছে সৌরবিদ্যুৎ এবং উইন্ডমিল থেকে।
কিন্ত বাংলাদেশে জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হওয়ায়, সোলার হোম সিস্টেম ও সোলার মিনি গ্রিড বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হেলাল বলেন।
তিনি জানান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের জন্য শিল্পকারখানা ও ভবনের ছাদে সৌরশক্তি স্থাপনে মানুষকে উত্সাহিত করা হচ্ছে। ছাদে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে।
ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) নির্বাহী পরিচালক মাহমুদ মালিক গত সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “শিল্পকারখানার ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মাধ্যমে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।”
স্রেডার নেয়া আরেকটি উদ্যোগ হচ্ছে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এবং সৌরসেচ। হেলাল উদ্দিন মনে করেন এগুলোর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বর্তমানে ২২,৭৮৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের পরিমাণ খুবই কম যা মোটের ওপর মাত্র তিন শতাংশ। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস্য সৌরবিদ্যুৎ। যার পরিমাণ ছিল গত বছর ৩৭২ মেগাওয়াট।
দেশে সৌরবিদ্যুতে এমন সময় এই ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যখন মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসার কথা ছিল।
বাংলাদেশ সৌর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দীপাল বড়ুয়া জানান, “বিদ্যুতের বিল একেবারে কম নয়। বাড়তি বিদ্যুৎ বিল থেকে বাঁচতে এখনো অনেক গ্রামের লোকেরা সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করছেন। সামনে যাহেতু বিদ্যুৎ খরচ আরও বাড়তে পারে সেজন্যও অনেকেই আগ্রহী হচ্ছে।”
তবে চলমান আন্তর্জাতিক উত্তেজনা এবং তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি থাকায়, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য একটি শক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যেন জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে না যায় এবং আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে পারি।
দীপাল বলেন, “নবায়নযোগ্য শক্তির কথা চিন্তা করে আমাদের একটা বাৎসরিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার যদি প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ করে তবে সৌরশক্তি উৎপাদনে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হবে।”
“জমির অপ্রতুলতাই সৌরশক্তি উৎপাদনের ধীরগতির জন্য দায়ী”, যোগ করেন তিনি।
Comments