মুক্ত বঙ্গবন্ধু লন্ডনে

বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সরকারি লিমোজিন ব্যবহার করতে অস্বীকার করেন এবং তার পরিবর্তে রেজাউলি করিমের গাড়িতে চড়েন।

সেই সংবাদ ছিল স্বপ্নময়তায় ভরা, মুহূর্তেই যার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল সুরের মূর্ছনার মতো... পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন, ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের পথে বঙ্গবন্ধু। যে কারাগারে দীর্ঘ নয় মাস বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে মৃত্যুর প্রচ্ছন্ন হুমকিতে।

আমাদের নেতা সুস্থ আছেন, আমাদের কাছে ফিরছেন- যাদেরকে বঙ্গবন্ধু নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন, যাদের  মুক্তির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করেছেন... আনন্দের এই বার্তা ছিল তাদের কাছে বাধভাঙা

সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বর্ণনাতীত, যারা সেই সময়ে ছিলেন না তাদের বোঝানো সম্ভব নয়, একজন মানুষ আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে তার মুগ্ধতা দিয়ে কতটা জায়গা করে নিয়েছিলেন, যাকে ছাড়া আমাদের স্বাধীনতাও ছিল অপূর্ণ। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে যার ফিরে আসা ছিল অপরিহার্য

মুজিববর্ষ- বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনে দ্য ডেইলি স্টার তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, স্বাধীন উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মুজিব কেন গুরুত্বপূর্ণ সেই কথাই তুলে ধরবে

দেশে ফেরার অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধু

লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা সজল চোখে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, “স্যার, আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছিলাম।”

এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ড. কামাল হোসেন এবং তার পরিবারকে পাহারা দিয়ে পাকিস্তানের বিশেষ বিমান থেকে লাউঞ্জে নেওয়া হচ্ছিল।

এর আগে, সদ্য মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতাকে রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা বিমানবন্দর থেকে বিদায় জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো।

একাত্তরে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়ের কয়েক দিন পর ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন ভুট্টো এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের তীব্র চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ঘোষণা করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি গভীর রাতে যাত্রা শুরু করেছিল। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কাউকে কিছু জানাননি ভুট্টো।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির শীতের সকালে বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাস বন্দী জীবন কাটিয়ে, একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে বিমান থেকে বের হলেন বঙ্গবন্ধু।

ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশের সময় ঘোষণা এল ‘শেখ মুজিবুর রহমান’-এর টেলিফোন কল এসেছে। বঙ্গবন্ধু ড. কামালকে ফোনে কথা বলতে বললেন।

ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের ইয়ান সাদারল্যান্ড। যিনি ড. কামালকে বলেছিলেন, একঘণ্টা আগেই ব্রিটিশ সরকার তাদের আগমনের খবর জেনেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

সতর্কতা হিসেব ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর এমএম রেজাউল করিমকে হিথ্রো বিমানবন্দরে পাঠিয়েছেন। রেজাউল করিম তখন লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

বঙ্গবন্ধু যখন লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলেন, তখন সেখানে আসেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার ও প্রাক্তন সাংবাদিক নাসিম আহমেদ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন, “স্যার, আমি আপনাকে স্বাগত জানাতে এসেছি। দয়া করে আপনি বলুন, আমরা আপনার জন্য কী করতে পারি?”

উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আপনি যথেষ্ট করেছেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছান ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।

ক্লারিজ হোটেলে বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা করার কথা জানান সাদারল্যান্ড। যেখানে সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানদের থাকার ব্যবস্থা করা হতো।

বঙ্গবন্ধু তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, যদি সম্ভব হয় রাসেল স্কয়ারের একটি সাধারণ হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। যেখানে তিনি আগের সফরে ছিলেন।

জবাবে সাদারল্যান্ড বলেছিলেন, “স্যার, আমার হাতে শুধু এই একটি উপায় রয়েছে, ক্লারিজ হোটেলই রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু, আপনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে চাইলে আমরা তার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করব। তবে, তা হবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই।”

এরমধ্যেই সেখানে পৌঁছান এমএম রেজাউল করিম।

তার আসার পর পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে সালাম দিয়ে বের হয়ে যান এবং তাদের দায়িত্বও সেখানেই শেষ হয়।

বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সরকারি লিমোজিন ব্যবহার করতে অস্বীকার করেন এবং তার পরিবর্তে রেজাউলি করিমের গাড়িতে চড়েন।

করিম তীব্র শীতের সকালে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তখন একই সঙ্গে তিনি উচ্ছ্বসিত এবং শঙ্কিত ছিলেন। কারণ ১৯৭১ সালের মার্চের পরে বঙ্গবন্ধুকে দেখা প্রথম বাঙালি ছিলেন রেজাউল করিম যিনি দেশের খবর জানতেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু তার কাছে যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ কীভাবে স্বাধীন হয়েছে তা জানতে চাইছিলেন। তবে গাড়িটি যেন দুর্ঘটনার মুখোমুখি না হয় এবং নতুন কোনো দুঃখজনক ঘটনা না ঘটে তা নিয়ে ভীত ছিলেন রেজাউল করিম।

ক্লারিজ হোটেলে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু তার পরিবার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বললেন। তারা তখন ঢাকায় ছিলেন।

সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিন আহমেদ জানান, ঢাকা থেকে লন্ডনে বিমানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে, লন্ডনে পৌঁছাতে কমপক্ষে দু’দিন সময় লাগবে।

তারা আরও জানান, ঢাকা ফেরার পথে দিল্লি ও কলকাতায় সাময়িক যাত্রাবিরতী জন্য অনুরোধ জানিয়েছে ভারতের মানুষ।

হোটেলে হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেন। যা নিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় হোটেল কর্তৃপক্ষকে। তারপরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পাঁচজনের একটি দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।

পরে হোটেলে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু।

তিনি বলেছিলেন, “আজ আমি মুক্তভাবে দেশবাসীর সঙ্গে স্বাধীনতার আনন্দ ভাগ করে নিতে পারছি। এক মহাকাব্যিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি।”

 “এই লড়াইয়ের চূড়ান্ত অর্জন হলো একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করা। আমি যখন কারাগারে বন্দী অবস্থায় ফঁসি কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম, তখন জনগণ আমাকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেছে।”

তিনি আরও বলেছিলেন, “স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ যে পরিমাণ মূল্য দিয়েছে এবং কষ্ট ভোগ করেছে, অন্য কোনো জাতিকে তা করতে হয়নি। আমি আমার দেশের মানুষের কাছে ফেরার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছি না।”

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

পশ্চিম পাকিস্তানে আটক এবং যেকোনো সময় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন এক সংবাদিক। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, যে মানুষ মরতে প্রস্তুত, তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না।”

আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি কী কখনো ভেবেছিলেন বাংলাদেশে স্বাধীন হবে? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি। যেদিন আমাকে কারাগারে নেওয়া হয় আমি বুঝতে পারছিলাম না বেঁচে থাকব নাকি মরে যাব। তবে, আমি জানতাম বাংলাদেশেরে মানুষ স্বাধীন হবে, তাদের কেউ দমাতে পারবে না।”

সন্ধ্যায় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু।

বৈঠকে ব্রিটিশদের বাংলাদেশকে সার্বভৌম দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দলিল অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারী হিথ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে এক বার্তায় বলেছিলেন “… তিনি (মুজিব) আত্মবিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কথা বলেছেন। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা পৌঁছাতে উদগ্রীব হয়ে আছেন তিনি…।”

“মুজিব আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এখন কোনো আনুষ্ঠানিক যোগসূত্র নেই। মুক্তির আগে ভুট্টোকেও একই কথা বলেছেন তিনি। এছাড়া প্রাচ্যের নিজস্ব মূল্যায়ন নিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন মুজিব।”

নিক্সনকে লেখা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বার্তাটিতে বলা হয়েছিল, “তিনি পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থার তিক্ততার কথা বলেছেন, তবে ভুট্টোর প্রতি কোন বিরক্তি প্রদর্শন করেননি। বরং তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।”

এতে আরও বলা হয়েছে, “তার ভাষায় নতুন বিভাজন হওয়া উচিত ‘ভাই বিচ্ছেদের মতো’। ভুট্টো পাকিস্তানের ভাগ মেনে নিয়েছে। ফলে নতুন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে।”

ঘোষিত নথিতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথের সদস্যপদ প্রত্যাশার কথা বলেছিলেন ‍ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে এবং তিনি আশ্বাসও দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে তারা বাংলাদেশকে কেন স্বীকৃতি দিতে পারেনি তার কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এতে বলা হয়েছে, “তিনি বলেছিলেন, আমরা ব্রিটেন এবং ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে মধুর সম্পর্ক রাখতে চাই। আমরা ভুট্টোকে বাস্তবতা মেনে নিতে সাহায্য করব।”

হিথ যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, আমরা আপনার জন্য আর কী করতে পারি? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আপনি আমাদের জন্য একটি কাজ করুন, যত দ্রুত সম্ভব আমাদের বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমান দিয়ে সাহায্য করুন।”

 বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ঢাকা পৌঁছাতে কত সময় লাগবে তার হিসাব করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিলো দিনের আলো থাকতেই ঢাকা পৌঁছানো।

দেখা যায়, যদি তারা বিকেল তিনটার মধ্যে ঢাকা পৌঁছতে চান তাহলে ভারতে শুধুমাত্র একটি যাত্রাবিরতী নিতে হবে। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কেবল দিল্লিতেই বিরতী নেবেন তারা।

বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর সামরিক বিমানে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ৯ জানুয়ারি ভোরে দ্রুততার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরের নেওয়া হয়।

সকাল ৬ টার দিকে ব্রিটিশ বিমানটিকে জ্বালানির জন্য নিকোলিয়া নেওয়া হয়। আর বিমানিটির চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল নয়া দিল্লি হয়ে ঢাকা পৌঁছানো।

(প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে, ড. কামাল হোসেনের আত্মজীবনী “Bangladesh: Quest for Freedom and Justice”, দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এমএম রেজাউল করিমের একটি প্রবন্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ঘোষিত নথির সাহায্য নিয়ে।)

আরও পড়ুন:

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago