বিআরটিএ ৪ বছর ট্র্যাকিং সিস্টেম ফি নিয়েছে ৫৬০ কোটি টাকা, সেবা প্রশ্নবিদ্ধ
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০১২ সালে যখন নতুন নম্বর প্লেট যা ডিজিটাল নম্বর প্লেট নামে বহুল প্রচলিত, তা দেওয়া শুরু করে। তখন তারা প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ডিজিটাল নম্বর প্লেট সম্বলিত গাড়ি চুরি হয়ে গেলে গাড়িটি ট্র্যাক করা যাবে এবং অপরাধমূলক কাজে গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছে কী না, সেটি শনাক্ত করা যাবে।
ডিজিটাল নম্বরপ্লেট সব গাড়ির জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই নম্বর প্লেট ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগের জন্য ফি ধরা হয়েছে, মোটরসাইকেল, তিন চাকার বাহনের জন্য দুই হাজার ২৬০ টাকা এবং চার চাকার বাহনের জন্য চার হাজার ৬২৮ টাকা।
বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে বিআরটিএ ১৬ লাখ ১২ হাজার ডিজিটাল নাম্বার প্লেট ও ট্যাগ সরবরাহ করে ৫৬০ কোটি টাকা আদায় করেছে।
কিন্তু ডিজিটাল নম্বর প্লেট দিয়ে যেসব সুবিধার কথা বলা হয়েছিল, সেটি গাড়ির মালিকরা পায়নি বললেই চলে। কারণ ডিজিটাল নম্বর প্লেটের ট্যাগ শনাক্ত করতে পারে, এমন চেক পোস্ট রয়েছে মাত্র ১২টি, যার সবগুলোই ঢাকায়। এছাড়া এভাবে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য কাউকেই নিয়োগ দেয়নি বিআরটিএ।
কয়েক মাস আগে আহমেদ রাফি নামে এক ব্যক্তির মামার মোটরসাইকেল চুরি হয়ে যায়। রাফি বলেন, ‘‘তারা (বিআরটিএ) সেবার নামে আমাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে। এ পর্যন্ত কোনো সেবা পেয়েছে বলে আমি শুনিনি।’’
নতুন এই পদ্ধতিতে সেবা পাওয়া তো দূরের কথা, এটির ব্যাপারে জানেনও না অনেক গাড়ির মালিক।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাসুক রানা। থাকেন মিরপুর-২ এ। তিনি জানান, ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাসার সামনে থেকেই তার মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। এ ঘটনায় তিনি মিরপুর থানায় মামলা করেন। এরপর থেকে যতবারই তিনি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, প্রত্যেকবার পুলিশ তাকে বলেছে অপেক্ষা করতে।
এই প্রতিনিধি মাসুককে আরএফআইডির কথা বললে তিনি জানান, এই ব্যাপারটি তার জানা ছিল না। তখন তিনিই উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘‘আদৌ কী এটি কাজ করে?’’
বিআরটিএ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অ্যান্টি-ভেহিকেল থেফট টিমের মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকার ফলে গত সাত বছরেও ডিজিটাল পদ্ধতির কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়নি চুরি যাওয়া গাড়ির মালিকরা।
বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মধ্যে গতানুগতিক পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করে যাতে সময় বেশি লাগে এবং যানবাহন ট্র্যাকিং কঠিন হয়ে যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘‘মানুষকে ফি দিতে বাধ্য করে সেবা না দেওয়াটা অন্যায়। বিআরটিএ’র উচিত আরএফআইডি শনাক্তকরণ যন্ত্র বাড়ানো এবং এগুলো সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য দক্ষ লোকবল নিয়োগ দেওয়া।’’
বিআরটিএতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ ডিজিটাল প্লেট এবং ট্যাগ রয়েছে যেগুলো বাহন মালিকরা এখনও নেয়নি। এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে বিআরটিএ ঘোষণা দিয়েছে, বাহন মালিকদের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই এগুলো নিতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে মানুষ আশানুরূপ সেবা না পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘‘মহাসড়কে আরও চেক পোস্ট স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তহবিল ঘাটতির কারণে সেই পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখতে পায়নি।’’
‘‘এখন আমরা পরিকল্পনাটি পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছি। এর জন্যে ডোনারের খোঁজ শুরু করব,’’ বলেছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান।
প্রকল্পটি কী ছিল?
বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তা জানান, যানবাহন ট্র্যাক করার মূল উদ্দেশ্য থেকেই ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর আরএফআইডি ট্যাগসহ নম্বর প্লেট লাগানোর প্রকল্প শুরু হয়েছিল।
পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য ডিজিটাল এই প্লেট ও ট্যাগ তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। বিএমটিএফ-কে মোটরসাইকেল কিংবা তিন চাকার বাহনের প্রতিটি প্লেটের জন্য এক হাজার ৮০৫ টাকা এবং চার চাকার বাহনের প্রতিটি প্লেটের জন্য তিন হাজার ৬৫২ টাকা পরিশোধ করে বিআরটিএ।
প্রথম পাঁচ বছরের জন্য বিএমটিএফ-কে প্রায় ৫৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিআরটিএ। এছাড়া পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য আরও ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধের কথা রয়েছে। তবে কতগুলো ডিজিটাল প্লেট লাগছে তার ওপর নির্ভর করে টাকার পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে।
আরএফআইডি শনাক্তকরণ যন্ত্রের দিয়ে কোনো যানবাহন গেলে এর রেজিস্ট্রেশন নম্বর, ফিটনেস সার্টিফিকেটের অবস্থা এবং কোনো ট্যাক্স বাকি আছে কী না, এসব তথ্য পাওয়া যাবে।
ডিজিটাল প্লেটগুলো রাতেও প্রায় ৪০ ফিট দূর থেকে দেখা যায়। অন্যদিকে ১১ মিটার দূর থেকেও যন্ত্র দিয়ে ট্যাগ শনাক্ত করা যাবে এবং কোন পথে গাড়িটি চলছে তা বলা যাবে।
ট্যাগ শনাক্তকরণ স্টেশন এ তথ্যগুলো বিআরটিএ-তে স্থাপিত সার্ভারে পাঠাবে। পুলিশ এবং বাহন মালিকরা চাইলে বিআরটিএ থেকে এসব তথ্য পাবে।
কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না বাহন মালিকরা
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গাড়ি চুরির ২৬০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ডিএমপির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ এই সময়ের মধ্যে ১৮৯ জন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে এবং ৪৩২টি গাড়ি উদ্ধার করতে পেরেছে।
বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত বছর চুরি হওয়া গাড়ির তথ্যের জন্য মালিকদের কাছ থেকে বিআরটিএ’তে অনুরোধ এসেছে মাত্র ১০-১২টি। এদের মধ্যে অর্ধেক মালিকই যখন ঢাকার বাইরে ছিলেন, তখন তাদের গাড়ি চুরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু বিআরটিএ তাদের কোনো সহায়তা করতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপি’র অ্যান্টি-ভেহিকেল থেফট টিমের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েক মাস ধরে তিনি এই টিমে কাজ করছেন। এসময়ে কখনও তিনি বিআরটিএ’র সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
‘‘পদ্ধতিটি কার্যকর থাকলে আমি জানতাম। বিগত কয়েক মাসে আমরা বেশকিছু বাহন উদ্ধার করেছি। কিন্তু তাদের কাছে থেকে কোনো সহায়তা নেইনি,’’ বলেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
বিআরটিএ’র দুই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘ট্যাগ শনাক্তকরণ যন্ত্র বসানোর জন্য আমরা বিভিন্ন মহাসড়কে ৯৪টি স্থান চিহ্নিত করেছিলাম। কিন্তু এর খরচ অনেক বেশি হওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং হাইওয়ে পুলিশের মধ্যে সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত এ প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে না।’’
Comments