ঘুষ না দিয়ে লালমনিরহাটের খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না কৃষক

লটারিতে নাম উঠা প্রতিজন কৃষক ২৬ টাকা দরে ১ মেট্রিক টন ধান বিক্রি করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু, অভিযোগ উঠেছে ধান বিক্রি করতে আসা চাষিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন জেলার সাতটি খাদ্য গুদামের সব কয়টিতে।
লালমনিরহাটের সরকারি খাদ্য গুদামে ধান নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সদর উপজেলার তিস্তা গ্রামের কৃষকরা। ১৯ জানুয়ারি ২০২০। ছবি: স্টার

লটারিতে নাম উঠা প্রতিজন কৃষক ২৬ টাকা দরে ১ মেট্রিক টন ধান বিক্রি করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু, অভিযোগ উঠেছে ধান বিক্রি করতে আসা চাষিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন জেলার সাতটি খাদ্য গুদামের সব কয়টিতে।

গুদামে ধান নিয়ে আসার পরই এক মেট্রিক টন ধানের বিপরীতে শ্রমিকদের শ্রম মজুরি বাবদ দিতে হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। আর ঘুষ হিসেবে এক হাজার টাকা দিতে হয় গুদাম কর্মকর্তাকে। সদর উপজেলার কালীবাড়ি পুরান বাজার ও ডালপট্টি খাদ্য গুদামে ঘুষের চিত্র সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে চাষিদের অভিযোগ।

চলতি আমন মৌসুমে লালমনিরহাট জেলায় ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৯ হাজার ৬৬৯ মেট্রিক টন। জেলায় এ বছর ৬৫ হাজার ২৯০ হেক্টর জমি থেকে ধান উৎপন্ন হয়েছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি গ্রামের ০৩৯৬ নম্বর কৃষি কার্ডধারী চাষি লেবুল ইসলাম (৫০) অভিযোগ করে বলেছেন, “ঘুষের টাকা না দিলে সরকারি খাদ্য গুদামে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রির কোন সুযোগই নেই।”

“সরকারি গুদামে ধান নিয়ে যাওয়ার পরই প্রথমে পরিশোধ করতে হয় শ্রমিকদের মজুরি তারপর ঘুষ দিতে হয় গুদাম কর্মকর্তাকে। তবেই তারা ধান মেপে গুদামে নেয়,” উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “আমিও ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছি।”

“ঘুষের টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ময়েশ্চার সমস্যা দেখিয়ে প্রথম দিন আমার ধান ফেরত দিয়েছিলেন খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা। কিন্তু, একই ধান দুদিন পর নিয়েছেন শুধু ঘুষের বদৌলতে,” যোগ করেন লেবুল ইসলাম।

“সরকারি খাদ্য গুদামে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে আমরা চরমভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। গুদাম শ্রমিকদের দিতে হয় বেশি মজুরি আর গুদাম কর্মকর্তাকে দিতে হয় ঘুষ। আমরা চাষিরা প্রতিবাদ করলে আমাদের ধানে দেখা দেয় ময়েশ্চারসহ নানা সমস্যা,” অভিযোগ করলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভিরকুটি গ্রামের ০০৪ নম্বর কৃষি কার্ডধারী আতাউর রহমান (৩৮)।

“সরকারি খাদ্য গুদামে আমরা নিরুপায়। কৃষকদের পুঁজি করে কালো টাকার পাহাড় গড়ছেন খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা-কর্মচারীরা,” অভিযোগ করেন তিনি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট গ্রামের ৭৪৯ নম্বর কৃষি কার্ডধারী চাষি হাসান আলী (৫৪) আক্ষেপ নিয়ে বললেন, কৃষকরা কষ্ট করে ধান উৎপন্ন করেন আর ভাগ্যগুণে লটারিতে নাম উঠে। কিন্তু, সেই ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি চলে খাদ্য গুদামে। “ঘুষের টাকা না দিলে ভাগ্য টিকে না সরকারি খাদ্য গুদামে। হয়রানি থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়েই ঘুষ দিতে হয় গুদাম কর্মকর্তা,” তিনি বলেন।

“সরকারি গুদামে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে এতো হয়রানির শিকার হয়েছি যে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না,” জানালেন হাসান আলী।

কোনো কোনো চাষি ঘুষ ঝামেলা এড়াতে ধান বিক্রির টোকেন আড়াই হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছেন দালালদের কাছে। আর দালালরা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে রমরমা ব্যবসা করছেন।

“লটারিতে নাম উঠায় খাদ্য গুদামে ধান নিয়ে গিয়েছিলাম বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পাওয়ার আশায়। কিন্তু, ময়েশ্চার সমস্যা দেখিয়ে ফেরত দেয়ায় হতাশ হয়ে পড়ি। ১৮ কিলোমিটার দূর থেকে ধান নিয়ে যাওয়া আর ফেরত আনা অনেক কষ্টের ছিলো। অযথা হয়রানির শিকার হতে চাইনি। তাই স্থানীয় এক দালালের কাছে ২,৫০০ টাকায় লটারির কুপনটি বিক্রি করে দিয়েছি,” জানালেন আদিতমারী উপজেলার গোবধা গ্রামের কৃষক সোলেমান আলী (৬৪)।

“চাষিদের ধানে ময়েশ্চার সমস্যা। কিন্তু, একই ধান দালালরা নিয়ে গেলে তাতে কোন সমস্যা থাকে না,” বলেও জানিয়েছেন তিনি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কালীবাড়ি পুরান বাজার ও ডালপট্টি এলাকায় সরকারি খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিনুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে জানান সাংবাদিকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলা যাবে না।

জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “সরকারি খাদ্য গুদামে কোনোভাবেই চাষিদের কাছ থেকে শ্রমিক ও গুদাম কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো টাকা নিতে পারবে না। সরকার লেবার হান্ডেলিং ঠিকাদারের মাধ্যমে গুদাম শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে থাকেন।”

তিনি বলেছেন, “আমরা খাদ্য গুদামে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি- যেনো কোনো চাষি কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হন। তারপরও যদি চাষিরা হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জেলা প্রশাসক আবু জাফরও বলেছেন একই কথা। “খাদ্য গুদামে চাষিদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে যদি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয় আর এর সঙ্গে গুদামের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত থাকলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেছেন জেলা প্রশাসক।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago