ভুলে যাওয়া প্রতিশ্রুতি
‘সীমান্তে হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’
ভারতের পক্ষ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি বারবার দেওয়া হচ্ছে।
‘বিএসএফ রাবার বুলেট ব্যবহার করবে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না।’
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের থেকে এমন প্রতিশ্রুতিও শুনেছে অসংখ্যবার।
২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তিনগুণ বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বিএসএফ।
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটলেই নিশ্চিতভাবে পতাকা বৈঠক হয় দুই দেশের মধ্যে। প্রতিবারই বাংলাদেশ যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে জানা যায়। আর ভারত প্রতিশ্রুতি দেয় হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার।
কিন্তু, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড চলছেই।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মতে, ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তিনগুণ বেড়েছে।
২০১৯ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কমপক্ষে ৪৩ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে, যদিও ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ১৪।
নতুন বছরের জানুয়ারি মাসের এই কয়দিনে কমপক্ষে সাত বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে।
দুই দেশের সরকারই বেশ জোর দিয়ে বলেছে যে গত দশকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
গতকাল (২৩ জানুয়ারি) নওগাঁ ও যশোর সীমান্তে চার বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলিতে, একজন নির্যাতনে। এর আগের দিন লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন আরও দুজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেছেন, “অবাক করা বিষয় যে দুই সরকারই পারস্পরিক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করলেও সীমান্তে হত্যার ঘটনা চলছেই। এর মানে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তার সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো আদেশই পাচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেছেন, “আমার কাছে মনে হচ্ছে, ভারত সরকার সীমান্ত হত্যাকাণ্ডকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দেয় না। পাশাপাশি আমরাও বিষয়টি নিয়ে সঠিকভাবে এগোতে পারছি না। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এরকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কী হতো ভাবুন!”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উচিত এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ জানানো এবং হত্যাকাণ্ড বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।”
বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। দুই দেশের ৪,১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তরেখা পৃথিবীর মধ্যে পঞ্চম।
গত ডিসেম্বরে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক পর্যায়ে দিল্লিতে একটি বৈঠক হয়। ভারতীয় কর্মকর্তারা সেখানে জানিয়েছিলেন, তারা বিষয়টি খেয়াল রাখবেন এবং সীমান্তে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু’ এড়াতে সচেষ্ট থাকবেন।
গত ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “ভারত আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সীমান্তে একজনকেও মারা হবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড চলছে, এটাই সত্য। আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন।”
প্রায়ই শোনা যায় যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে গরু পাচারের সময়।
কিন্তু, বাংলাদেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সে কারণে, গত কয়েকবছরে গরু পাচারের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।
২০১৪ সালে গরু রপ্তানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগের বছর ঈদুল আজহায় প্রায় ২০ লাখ ৩০ হাজার গবাদি পশু ভারত থেকে এসেছিলো বাংলাদেশে। বিজিবির তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজারে।
সীমান্তে গত বছর নিহত ৪৩ বাংলাদেশির মধ্যে ৩৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং বাকিরা নিহত হয়েছেন নির্যাতনের শিকার হয়ে।
আসকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ২৪ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন এবং ২০১৫ সালে ৪৬ জন বাংলাদেশি নিহত হন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে।
গতকালের চারজন
গতকাল নওগাঁর পোরশা সীমান্তে তিনজনকে গুলি করে এবং যশোরের শার্শা উপজেলার পুটখালী সীমান্তে একজনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
নওগাঁর পোরশা সীমান্তে বিষ্ণুপুরের মফিজুল (৩৫), বিজলির সন্দ্বীপ (৩২) এবং পটাপুকুরের কামাল হোসেন (৩৪) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, বিজিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বিকালে বিজিবি-বিএসএফের বৈঠকে বিএসএফ কর্মকর্তারা হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন বিজিবি ব্যাটালিয়ন-১৬ এর লে. কর্নেল একেএম আরিফুল ইসলাম।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা জানিয়েছেন, নিহত তিনজনের সঙ্গে বিএসএফ সদস্যরা কাবিল নামে ২৭ বছর বয়সী এক যুবককেও আটক করেছিলেন।
গতকাল বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন যশোরের শার্শার অগ্রভুলোট এলাকার হানিফ আলী খোকা (৩৫)। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ২২ জানুয়ারি বিকালে তাকে আটক করা হয়েছিলো।
দুপুরের দিকে মফিজুলের মৃতদেহ বাংলাদেশের ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে পোরশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহিনুর রহমান জানিয়েছেন।
যশোরের হানিফকে সেদিন বান্নাবাড়িয়া সীমান্ত চৌকির বিএসএফ সদস্যরা আটক করেছিলো বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তৈবুর রহমান।
Comments