১৬৬ বছরের চা চাষের ইতিহাসে উৎপাদনে রেকর্ড, শ্রমিকের ভাগ্যের নয়
সর্বশেষ মৌসুমে বাংলাদেশে চা উৎপাদনের ১৬৬ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে চা উৎপাদিত হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি। গত বছরের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ কেজি। এক বছরে চা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। তবে, চা শিল্পের উন্নতি হলেও উন্নতি হচ্ছে না চা শ্রমিকদের জীবনে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া চা উৎপাদন মৌসুমে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৮২ দশমিক ১৩ মিলিয়ন কেজি। যা দেশের চা উৎপাদন মৌসুমের (২০১৮) সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল। ২০১৮ সালের চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৭২ দশমিক ৩ মিলিয়ন কেজি। এর আগে ২০১৬ সালে সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয়েছিলো ৮৫ দশমিক শূণ্য পাঁচ মিলিয়ন কেজি।
ট্রেড ইউনিয়ন মৌলভীবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস পাল বলেছেন, “অথচ সারাদিন কাজের পর একজন চা শ্রমিকের আয় হয় ১০২ টাকা। তাদের নেই নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক জাতিগত পরিচয়, নেই লেখাপড়ার সুযোগ, নেই স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন, নেই যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ। কিছুটা শিক্ষিত যারা আছেন তাদেরও ১০২ টাকা রোজে নির্দিষ্ট কাজ করতে হয়, নতুবা হারাতে হয় মাথা গোঁজার জায়গাটুকু। কাজ করতে গিয়ে অঙ্গহানি ঘটলেও কোনো সাহায্য পান না তারা। নিজের অধিকার নিয়ে যেন সোচ্চার না হতে পারে সেজন্য মালিকপক্ষের সহযোগিতায় নেশার ঘোরে রাখা হয় শ্রমিকদের। পরিকল্পিত ভাবে প্রতিটি চা বাগানে আছে মদের দোকান।”
এমনি এক হতভাগ্য জনগোষ্ঠী চা শ্রমিকরা। ব্রিটিশ শাসনামলে সুন্দর জীবনযাত্রার লোভ দেখিয়ে বঙ্গভূমিসহ বিভিন্ন স্থানে আনা হলেও শুরু থেকেই তাদের কপালে জুটেছে শুধু অবহেলা-নির্যাতন। এরা যেন আজকের যুগে আধুনিক ক্রীতদাস।
জুলেখা চা বাগানের চা শ্রমিক মেনকা সাঁওতাল জানান, স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। এমনকি মৌলিক অধিকারও তারা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। চা বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনও ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্রমতে, দেশে চা জনগোষ্ঠী প্রায় ৭ লাখ। তার মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় ৯৮ হাজার, অনিয়মিত শ্রমিক প্রায় আরও ৩০ হাজার। একজন চা শ্রমিকের সাপ্তাহিক বেতন ৭১৪ টাকা। সপ্তাহে দেয়া হয় ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম চাল বা আটা (বাজার দর হিসেবে যে পণ্যের দাম কম)।
দেওরাছড়া চা বাগানের চা শ্রমিক বৃটিশ ঘাটুয়াল জানিয়েছেন, ৫-৬ সদস্যের অনেক পরিবার আছে যেখানে এক জন কাজ পাচ্ছেন আর বাকিরা এই ১০২ টাকার উপর নির্ভর করেই দিন চালাচ্ছেন। ছোট ভাঙাচোরা ঘরে থাকতে হয় গবাদি পশুসহ সন্তানদের নিয়ে। বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না বছরের পর বছর। তাদের নেই নিজস্ব কোনো জায়গা। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গাও হারাতে হবে।
সিলেট চা জনগোষ্ঠী ছাত্র যুব কল্যাণ পরিষদের সভাপতি দিলিপ কুর্মী বলেছেন, “২০১৬ সালের চুক্তি অনুসারে একজন শ্রমিককে অবসর ভাতা হিসেবে সে যত বছর কাজ করেছে তার মোট বছরের গড়ে দেড় মাসের বেতন হিসাবে পেনশন দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা শুধু কাগজে কলমে। বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের বোঝা হয়ে অর্ধাহার-অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মরতে হয় তাদের। মাত্র কয়েকটি বাগানে নামমাত্র চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ বাগানে সেটা নেই।”
বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা দেবাশীষ যাদব বলেছেন, “এত কষ্টের মাঝেও সব থেকে বেশি কষ্ট লাগে যখন সমাজের বড় একটা অংশ আমাদের বলে আমরা ভারতীয়। চা শ্রমিকরা যখন বঙ্গে আসেন তখন ভারতবর্ষ ভাগ হয়নি। আমরা শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেছি।”
সবারই নিজস্ব জাতিগত পরিচয় থাকলেও চা শ্রমিকদের সেটা নেই। নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি থাকলেও কোনো স্বীকৃতি এখনও আদায় করতে পারেননি তারা।
এত বঞ্চনার পরও তারা কেন প্রতিবাদী হতে পারেন না এমন প্রশ্নের জবাবে চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু ধলাই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি বলেছেন, “আমাদের কষ্টের কথা বলে শেষ করা যাবে না। নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝে শ্রমিকরা যেন ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে সেজন্য মালিকপক্ষের পরোক্ষ সহযোগিতায় মদের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করে তাদের মাতাল করে রাখা হচ্ছে।”
ট্রেড ইউনিয়ন মৌলভীবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস পাল জানিয়েছেন, একজন চা শ্রমিক বাগানে কাজ না করলে তাকে বাগানে থাকতে দেওয়া হয় না। অথচ প্রায় প্রতিটি বাগানে নিম্নমানের মদের দোকান আছে। যেসব দোকানের মালিক এবং কর্মচারীদের বাগানের কোনো কাজ ছাড়াই সেখানে থাকার জন্য জায়গাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে বাগানের মালিকপক্ষ।
চা–বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি শাহ আলম বলেছেন, “চা–বাগানে কয়েক বছর ধরে কার্যত সংস্কার কার্যক্রম চলছে। পুরনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা লাগানো হয়েছে। বাগান মালিকেরা নতুন করে বিনিয়োগ করে চা চাষের আওতা বাড়িয়েছেন। গত বছর চা চাষের উপযোগী আবহাওয়া ছিলো। এবারের মতো যদি উৎপাদন বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে আর বড় আকারে আমদানি করতে হবে না।”
বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলী বলেছেন, “চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ চলছে। প্রতিটি বাগানে প্রাথমিক স্কুল স্থাপন করা হচ্ছে।”
Comments