খাবার ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন

সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে সেই খাবারের ইতিহাস জানতে পারার অভিজ্ঞতা বেশ চমৎকার। খাবার টেবিলেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের নানা দিক ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা যায়।
বেচারাম দেউড়ি এলাকার নূর বক্স লেনের ২০০ বছর পুরনো জমিদার বাড়ি। ছবি: হাসান মীর

সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে সেই খাবারের ইতিহাস জানতে পারার অভিজ্ঞতা বেশ চমৎকার। খাবার টেবিলেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের নানা দিক ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা যায়।

পুরান ঢাকার কথাই ধরা যাক। শুধু পুরনো স্থাপনাই না বরং নানা পদের সুস্বাদু খাবার আর আতিথেয়তাতেও প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় এখানে।

তাই, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সম্পর্কে বলতে গেলে খাবারের কথা উল্লেখ করতেই হবে। ঐতিহ্যবাহী খাবারদাবারকে এই পুরনো শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মনে হয়।

প্রমাণ মিলবে, বেচারাম দেউড়ি এলাকার নূর বক্স লেনের ২০০ বছরের পুরনো জমিদার বাড়িতে। অতিথিদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা আছে এখানে।

এ দোতলা বাড়িটি উনিশ শতকে নির্মাণ করা হয়েছিল। তিন প্রজন্ম ধরে ঢাকা এবং সোনারগাঁওয়ের জমিদার ছিলেন মৌলভী আবুল খায়েরাত মুহাম্মদ। বর্তমানে এ বাড়ির মালিক তার ষষ্ঠ প্রজন্মের বংশধর এএম ইমরান।

সপ্তাহের এক কর্মদিবসে বাড়ির লোকজনকে আগে থেকে কিছু না জানিয়েই সেখানে গিয়েছিলাম আমরা। তবে একেবারেই বিরক্ত হননি ইমরান। আতিথেয়তার জন্য বিখ্যাত বংশের ছেলের মতোই আমাদেরকে স্বাগত জানান তিনি।

প্রায় ছয় বিঘা জমির উপর নির্মিত এ জমিদার বাড়ি। প্রশস্ত বাগানের মাঝখানে দেয়াল তুলে সেটিকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। ‘ইউসুফের প্রাসাদ’ নামের বাড়িটি এখন তিন ভাগে বিভক্ত। তার একভাগে, প্রায় দেড় বিঘা জমিতে বংশের গৌরবকে আঁকড়ে আছেন ইমরান। অন্য অংশে আত্মীয়স্বজনরা পুরনো স্থাপনা ভেঙে নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন।

ইমরানের পূর্বপুরুষের নামে নূর বক্স এবং আবুল হাসনাত সড়ক দুটির নামকরণ করা হয়েছে।  পুরনো হলেও বাড়িটি দেখাশোনায় কোনো ত্রুটি নেই। নকশাকাটা স্তম্ভ এবং রেলিংগুলো দেখে সহজেই তা বুঝতে পারা যায়। দিনের বেলায় জানালার কাঁচের নকশার উপর সূর্যের আলো এসে মেঝেতে নানা আঁকিবুঁকি করে। দেখলে মনে হয়, যেন সেই পুরনো সময়ে ফিরে গেছি।

কয়েক দশক ধরে এভিয়েশন সেক্টরে কাজ করেছেন ইমরান। তিনি জানান, “আমাদের বাড়ি আতিথেয়তার জন্য বিখ্যাত ছিল। অনেক বিখ্যাত মানুষজন এখানে ঘুরতে এসেছেন, থেকেছেন।”

আরবান স্টাডি গ্রুপ (ইউএসজি) নামের একটি সংগঠন পুরান ঢাকার স্থাপত্য এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করে। ইউএসজির সহায়তায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়িতে রেস্তোরাঁ চালু করেন ইমরান।

ধীরে ধীরে জনসমাগম বাড়তে থাকে ‘ইমরানস হেরিটেজ হোম’-এ। এমনকি বিদেশি দর্শনার্থীরাও ইমরানের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেতে আসেন নিয়মিত। শুধু সুস্বাদু খাবারের জন্য নয়, সংরক্ষিত প্রাচীন নকশা ও শিল্পকর্মের টানে এখানে মানুষ ভিড় জমান।

ইমরান আমাদেরকে তার সংরক্ষিত মূল্যবান জিনিসগুলো দেখান। সোনার প্রলেপ দেওয়া দুইশ বছরের পুরনো কোরআন শরিফ, আতরদানি, হাতে লিখা বই, আতরসহ নানা সামগ্রী এ বাড়িতে তার সংগ্রহে আছে।

একসময় অতিথিরা এলেন। তাদের মধ্যে একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিয়া নিগার। ফেসবুকের মাধ্যমে জায়গাটির সন্ধান পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

তার সাথে থাকা বন্ধু ব্যবসায়ী সোহানুর রহমান বাড়িটি ঘুরে দেখার সময় একটি বিছানা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ইমরান তাকে জানান, ‘এস এম সুলতান একসময় এ বিছানায় ঘুমিয়েছেন।’

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিশোওয়ার আমিন ধানমণ্ডি থেকে যানজট পার করে তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে যোশরা জাহিরাকে নিয়ে এসেছেন ‘ইমরানস হেরিটেজ হোম’-এ। বাড়িটি ঘুরে দেখার সময় তিনি জানান, “শহরের এ অংশে অনেক লুকানো রত্ন আছে। দর্শনার্থীরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পুরনো ঐতিহ্যগুলো সম্পর্কে জানতে পারেন।”

দুপুরের খাবারের কথা মনে করিয়ে দিলেন ইমরান। একসময় আবুল খায়রাতের ব্যবহার করা টেবিলে খেতে বসলাম আমরা।

খাবারের আয়োজনে ছিল জাফরানি পোলাও, শাহী কোরমা, মুরগীর চাপ, মোরগ খানা, চিংড়ি মালাই, সালাদ এবং বোরহানী। সবশেষে জর্দাও পরিবেশন করা হলো।

ইমরান নিজ হাতেই আমাদেরকে আপ্যায়ন করান। খাবারগুলো খুবই সুস্বাদু ছিল।

প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন পদের খাবার পরিবেশন করা হয় বলে জানান ইমরান। অতিথিরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী আনারস ইলিশ, দোলমা কিংবা কোফতাও খেতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে আগে থেকেই জানিয়ে রাখতে হবে।

সব খাবারই বাড়িতে রান্না হয়। ইমরানের স্ত্রী এবং বোনেরা খাবারগুলো রান্না করেন। সুস্বাদু খাবারের রাঁধুনিদের সম্পর্কে জানতে চাইলে ইমরান জানান, “ওরা সবাই চমৎকার রান্না করতে পারেন।”

তিন সন্তানের বাবা ইমরান তার এই ভিন্নধর্মী ব্যবস্থা সম্পর্কে জানান, “আমরা এভাবেই আমাদের ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ করছি। ঐতিহ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো একবার হারিয়ে গেলে আর কখনোই ফেরত পাওয়া সম্ভব না।”

এ বাড়িতে খেতে হলে অন্তত দুই দিন আগে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে।

ইমরান জানান, রেস্তোরা থেকে উপার্জিত অর্থ তিনি বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ করেন।

পূর্বপুরুষ নিয়ে গর্বিত এ ব্যক্তি বলেন, “এটা কোনো রেস্টুরেন্ট না। যারা এখানে আসে তারা সবাই আমাদের পরিবারের সদস্য।”

হেরিটেজ ম্যাগনেট

আরবান স্টাডি গ্রুপ (ইউএসজি) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৈমুর ইসলাম জানান, ‘হেরিটেজ ওয়াক’ নামের নিয়মিত কর্মসূচির মাধ্যমে তারা পুরান ঢাকার বাড়ি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন।

ঐতিহ্য সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন করা এ কর্মী জানান, “যদি আপনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে মালিকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, সময় কাটাতে পারেন, খাবার খেতে খেতে তাদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে থাকতো সে সম্পর্কে জানতে পারেন তাহলে সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা আপনার হবে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য পুরান ঢাকায় এরকম কিছু ‘হেরিটেজ ম্যাগনেট’ তৈরি করা। অভিজ্ঞতাকে আরও আনন্দদায়ক করতে আমরা খাবার পরিবেশনের সাথে প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচিরও পরিকল্পনা করছি।”

তবে, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন মোটেও সহজ না। তৈমুর জানান, “পুরান ঢাকার বাসিন্দারা তাদের ঐতিহ্য নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। অতিথিরা টাকার বিনিময়ে আতিথেয়তা গ্রহণ করবে এমন ধারণায় তারা একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। কিন্তু, উপার্জিত টাকা দিয়ে তারা নিজেদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে পারবেন এটা আমরা তাদেরকে বুঝিয়েছি। রোকনপুরের আরেকটি বাড়িতে আমরা একইরকম উদ্যোগ নিয়েছি। নাম কাজী বাড়ি। যদি আমরা অন্তত ১০-১৫টি জায়গায় এটা চালু করতে পারি তবে মানুষ পরিবারসহ পুরান ঢাকায় সময় কাটাতে আসবেন।”

কাজী বাড়ি

প্রায় ২০০ বছরের পুরনো স্থাপনার জন্য পরিচিত ঐতিহ্যবাহী কাজী বাড়ি।

বাড়ির বাসিন্দারা ২০১৯ সালে সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবারের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবারের ব্যবস্থা করে। সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি মানুষ এ বাড়িটিকে ঘুরে দেখেন। বাড়িটির প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প দর্শনার্থীদের নিয়ে যায় কয়েক দশক অতীতে।

মির্জা এলাহি বক্সের উত্তরসূরি কাজী সাদ উল্লাহ আলিম বর্তমানে এ বাড়ির মালিক। আঠারো শতকে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। বাড়ির পাশাপাশি একটি মসজিদের জমির মালিকানাও তার। সাদ জানান, মসজিদটি বাড়ির চেয়েও পুরনো।

তিনি জানান, প্রায় তিন থেকে চার মাস আগে তিনি ইউএসজি সম্পর্কে জানতে পারেন। সাদ বলেন, “ওরা আমাকে পুরান ঢাকা নিয়ে তাদের পরিকল্পনা এবং কীভাবে এর ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে সামনে আনা যায় সেসব কথা বলেছিলেন।”

নানাসময়ে অনেক স্থানীয় এবং বিদেশি অতিথিরা বাড়িটিতে ঘুরতে এসেছেন।

সাদ জানান, “আমরা আমাদের পরিবারের ইতিহাস তাদেরকে জানাই। এই জায়গার সঙ্গে, পাড়ার সাথে আমাদের ৪০০-৫০০ বছরের যে পুরনো সম্পর্ক সেসব কথা তাদেরকে বলি।”

বাড়িতে সংরক্ষিত পুরনো শিল্পকর্মগুলোকেও দর্শনার্থীরা আগ্রহ নিয়ে দেখেন।

বিগত ৬০ দশক ধরে কাজী বাড়ি দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও বড় অবদান রেখেছে। সাদের বাবা কাজী আব্দুল আলীম কেবল একজন কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদই ছিলেন না, তিনি শরীরচর্চার প্রশিক্ষক এবং লেখক হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন।

খেলাধুলায় কৃতিত্বের পাশাপাশি ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি সুনাম অর্জন করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ইউনেস্কো পুরস্কার অর্জন করেন কাজী আব্দুল আলীম।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago