বাংলাদেশি লুটেরাদের বিরুদ্ধে কানাডায় সামাজিক আন্দোলন

Canada protest-1.jpg
বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অর্থপাচারের বিরুদ্ধে টরেন্টোর হোপ ইউনাইটেড চার্চ মিলনায়তনে প্রতিবাদী অনুষ্ঠান। ২৪ জানুয়ারি ২০২০। ছবি: সংগৃহীত

১. বাঙালি পাড়া হিসেবে খ্যাত ডেনফোর্থেই তার সঙ্গে সাক্ষাত। ঠিক কে যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন- মনে করতে পারছি না। ‘উনি চাটগাঁইয়া’- এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কেউ একজন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, সেই হিসেবে অনেকেই আমাকে চাটগাঁইয়াই ভাবেন।

তিনি কথা শুরু করলেন চাটগাঁইয়া বাংলায়। দু এক মিনিট না যেতেই রাস্তার উল্টোদিকের ফিটনেস ক্লাবটা দেখিয়ে জানতে চাইলেন- এর মালিক কে জানেন? পরমুহূর্তেই বললেন- আমি এই বিল্ডিংটা কিনবো।

হতবিহ্বলের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এই বিশাল বিল্ডিংটা তিনি কিনতে চান! অথচ তিনি বলছিলেন- তিনি কদিন হয় মাত্র কানাডায় এসেছেন। কীভাবে সম্ভব!

কয়েকদিনের মধ্যেই জানা হয়ে যায়, শিপ ব্রেকিং ব্যবসায় জড়িত এই ব্যক্তি কয়েকটি ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ না করেই কানাডায় চলে এসেছেন। টরন্টোয় চলতে ফিরতে যা দেখেন, সব কিছুই কিনে ফেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলাদেশের ব্যাংকের পাওনা ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ না করলেও, টরন্টোয় কয়েকটি বাড়ি কেনায় সমস্যা হয়নি তার।

২. ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতি থেকে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে এসেছিলেন। কানাডায় পা দিয়েই বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষীদের ‘যোগ্যতাকে’ চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। ‘এতো বছর কানাডায় থেকে তোমরা কি করেছো?’- তার এই প্রশ্নে বন্ধুরা যেনো অসহায় হয়ে পরে। বুকটাকে টানটান করে তিনি ঘোষণা দেন- কানাডার ব্যাংকারদের আমি ঘুষ খাওয়া শিখাবো। বাংলাদেশে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে হয় না। কানাডায়ও সেটা আমি চালু করবো। ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দিতে হবে না।

কিছুদিন পরই পত্রিকার শিরোনাম হন এই লোক। কানাডার ব্যাংক ব্যবস্থায় ঢুকতে পারেননি তিনি, বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে মেরে আনা টাকা সেই রিপোর্টের বিষয়বস্তু। স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই টরন্টোয় দুটি বাড়ি কিনেছেন তিনি। বিনিয়োগ করেছেন একটি রেস্তোরাঁয়। অথচ বাংলাদেশে তিনি ব্যাংকের ঋণ খেলাপি।

৩. দুটি ঘটনা উল্লেখ করলাম উদাহরণ হিসেবে। খোঁজ করলে এই ধরনের আরও অসংখ্য ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাবে। কানাডার বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, আমলাদের বিলাসী জীবনযাপন বাংলাদেশি কমিউনিটি ছাড়িয়ে ভিন্ন কমিউনিটিতেও  আলোচিত হয়। আলিশান বাড়ির সামনে লেটেস্ট মডেলের কয়েকটি করে গাড়ি, অথচ কানাডায় দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা কিংবা চাকরি নেই এমন জীবনযাপন সঙ্গত কারণেই তাদের প্রতি প্রতিবেশীদের কৌতূহলী করে তুলে। সেই কৌতূহল থেকেই কমিউনিটি থেকে অন্য কমিউনিটিতে ছড়িয়ে যায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো কোনো পরিবারের চোখ ধাঁধানো জীবনযাপনের গল্প। তাদের এই ধরনের বিলাসী জীবনের টাকা আসে মূলত বাংলাদেশ থেকে।

বাংলাদেশে কি টাকার খনি আছে? নইলে সেই দেশ থেকে টাকা এনে উত্তর আমেরিকার একটি শহরে এমন বিলাসী জীবনযাপন কীভাবে সম্ভব হয়? এমন প্রশ্ন অন্য কমিউনিটিতে প্রায়শই উচ্চারিত হয়। অথচ এদের অনেকের নামই বাংলাদেশের মিডিয়ায় আসে ঋণখেলাপি হিসেবে।

কেবল কি ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীরাই কানাডায় বিলাসী জীবনযাপন করেন? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ চেনা জানা নেতাদের নামে কানাডার কোন শহরে কয়টি বাড়ি আছে, এগুলো নিয়ে কমিউনিটিতে গুঞ্জন হয়, কিন্তু সেগুলো নিজের নামে কেনা নয় বলে দালিলিকভাবে চিহ্নিত করা যায় না। সাবেক এক মন্ত্রীর মেয়ের জামাই তৃতীয় একটি দেশ থেকে কানাডায় অভিবাসী হয়েই যখন বিশালাকায় ম্যানশন কিনে ফেলেন- মানুষের মনে তখন নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। উপসচিব, যুগ্মসচিব পর্যায়ে সরকারি চাকুরীতে থাকা কোনো কোনো কর্মকর্তা যখন মিলিয়ন ডলার দিয়ে বাড়ী কিনে রেখে নিজের চাকরিতে ফিরে যান, তখন প্রবাসীরা কেবল বিস্মিতই হন না, ক্ষুব্ধও হন। পদমর্যাদা এবং আয়ের সঙ্গে টরন্টোয় মিলিয়ন ডলার দিয়ে বাড়ি কিনে ফেলাটা যে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেটা কারোরই বোঝার বাকি থাকে না বলেই এই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিশাল অংকের টাকা মেরে দিয়ে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থগুলো কানাডায় এসে কানাডাকেও ‘বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলবার’ স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন এদের অনেকেই। নানা অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে আলোচিত অনেকেই কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে শোনা যায়। ডেসটিনির দুর্নীতির টাকার বড় অংশই টরন্টোয় রয়েছে বলে গুঞ্জন আছে। দুদক কর্তৃক দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞায় থাকা একটি টিভি চ্যানেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার পরিবারের সদস্যদের টরন্টোয় রেখে গেছেন বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচারের অভিযোগ করেছে দুদক। তিনি কি শুধু পরিবারের সদস্যদের রেখে গেছেন টরন্টোয়? ‘মুদ্রা-টুদ্রা’ রেখে যাননি? তার এবং স্ত্রীর নামে টরন্টোয় একটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে, যেটি ৩.৮ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে। এই টাকাটা বাংলাদেশ থেকে কি আসেনি? বহুল আলোচিত একজন ডিআইজির পরিবার এখন টরন্টোয় থাকে বলে আলোচনা আছে। এভাবে তালিকা করলে সেই তালিকাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। এই সব নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চাপা পড়েছিলো অনেক দিন। সেই ক্ষোভটাই যেনো বিস্ফোরিত হয়েছে সম্প্রতি।

৪. বাংলাদেশের মূলধারার পত্রিকায় বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিশাল অংকের টাকা মেরে দেওয়ার কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। সেই খবরে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারীদের কানাডা কানেকশনের চিত্র প্রকাশ পায়। একটি পত্রিকায় গাজী বেলায়েত হোসেনের দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর পুরো কমিউনিটিতে যেনো বিস্ফোরণ ঘটে। গাজী বেলায়েত কমিউনিটিতে সম্পৃক্ত হয়ে পরেছিলেন এবং বিভিন্ন আয়োজনে মোটা অংকের অনুদানের ঘোষণা দিতেন। ফলে তাকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদটি কমিউনিটিতে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। ডেসটিনি থেকে শুরু করে সব লুটেরাদের প্রতিই ধিক্কার জানাতে শুরু করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। শুরু হয় সামাজিক আন্দোলন।

৫. কানাডা যেনো বাংলাদেশের চোর ডাকাতদের অভয়ারণ্য না হয়ে ওঠে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা সে চেষ্টা করছেন। বরফ ঝড়কে উপেক্ষা করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রাস্তায় মানববন্ধন করেছেন, প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় মুদ্রা পাচার বন্ধ এবং ইতিমধ্যে কানাডায় বসতি গড়া টাকা পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবিতে অনলাইনে স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজও শুরু করেছেন তারা।

ভিনদেশে স্বদেশের লুটেরাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের আন্দোলন কী ফল দেবে? এমন প্রশ্ন কারও মনে জাগতেই পারে। কিন্তু আন্দোলনে অংশ নেওয়া টরন্টোয় বসবাসরত বাংলাদেশিরা পরিষ্কারভাবেই বলছেন, লুটেরা এবং অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তারা একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ এই উদ্যোগের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, “আমাদের একটি নিরাপদ গন্তব্য আছে, বাংলাদেশের চোর ডাকাতদের মনে যেনো এই বোধ তৈরি না হয়- এমন একটি বার্তাই আমরা দিতে চাই। বাংলাদেশের লুটেরা, অর্থপাচারকারীদের জন্য কানাডা আর নিরাপদ শহর নয়, সেই পরিবেশ তৈরির জন্যই এই সামাজিক আন্দোলন।”

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago