পাহাড়ের পাহাড়ি উচ্ছেদ কবে বন্ধ হবে

Bandarban
ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে বান্দরবানের ৮টি মৌজায় প্রায় ২৩০টি জুম্ম পরিবারকে তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

মূলত বাঙালি বসতি স্থাপন, রাবার বাগান তৈরি এবং পর্যটনের নামেই দখল হয়েছে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর জুম ভূমি।

বান্দরবানের লামা উপজেলার মংবিচর বাচিং মারমাপাড়া, চারিজ্ঞ্যা ত্রিপুরা কারবারিপাড়া, আমতলি ম্রোপাড়া,  লুলাইনমুখ ম্রোপাড়া এবং সুনাং ম্রোপাড়া; নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রাঙ্গাঝিরি চাকমাপাড়া, ডলুঝিরি মারমাপাড়া, বাদুরঝিরি চাকপাড়া, লং-গদু চাকপাড়া, হামরাঝিরি মারমাপাড়া, সাপমারাঝিরি পাড়া এবং শুই জাইং চাকপাড়া; আলীকদমের উকলিংপাড়া, মেনসম ম্রোপাড়া এবং সদর উপজেলার সাইংগা মারমাপাড়া থেকে পাহাড়ি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

উচ্ছেদ হওয়া ম্রো, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা এবং চাক পরিবারগুলো এখন বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর সদস্যরা বলছেন, হুমকি ও নানা প্রতিকূলতায় বাধ্য হয়ে তারা গ্রাম বা পাড়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির ২২ চাক পরিবারকে উচ্ছেদ করার জন্য ১৪ ভূমি দখলদারকে গ্রেপ্তারের সুপারিশ করেছিলো। এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

১৯৮৯ সালের ৩ আগস্ট প্রকাশিত গেজেট প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পার্বত্য এলাকার বাসিন্দা নয় এমন ব্যক্তিকে কোনো জমি হস্তান্তর করা যাবে না।

এছাড়াও, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য  চুক্তি অনুযায়ী অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা হলো “অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দাদের অর্থ এমন ব্যক্তি হবেন যিনি উপজাতি নন তবে পার্বত্য জেলায় বৈধ জমি আছে এবং সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাহাড়ের জনপদে বসবাস করেন।”

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ অনুসারে, “বান্দরবান পার্বত্য জেলার অধিক্ষেত্রের অধীনে কোনো জমি... কাউন্সিলের পূর্ব অনুমোদনের বাইরে ইজারা দেওয়া, বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় বা হস্তান্তর করা যাবে না।”

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় পার্বত্য চুক্তির পরেও অন্য অঞ্চলের প্রভাবশালীরা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পাহাড়ে হাজার হাজার একর ভূমির বৈধ মালিকানা পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন।

বিগত বহু বছর ধরে এটি চলছে।

ভূমি হারানো অনেক পাহাড়িই তাদের জীবনের ভয়ে লিখিত অভিযোগ করতে সাহস পান না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব ছিলো ঘটনাগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করে পাহাড়িদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

পাহাড়িদের সুরক্ষা সরকারের এক পবিত্র দায়িত্ব।

সুতরাং, উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা পাহাড়িদের উচ্ছেদ, এবং প্রতিনিয়ত তাদের ভূমি হারানোর বিষয়গুলো আন্তরিকভাবে তদন্ত করে, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং উচ্ছেদ হওয়া পাহাড়ি পরিবারগুলিকে তাদের হারানো বাড়িঘর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।

পাহাড়ে যে ব্যক্তির স্থায়ী আবাসস্থল নেই বা যিনি স্থায়ী বাসিন্দা নন, তিনি শত শত একর জমি কীভাবে কিনতে পারছেন? চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোনোভাবেই তা পারার কথা নয়। সুতরাং পাহাড়ের সমস্যার সমাধান চাইলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

ভূমি বিক্রয় ছাড়পত্র দেওয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তারা যে আইনবিরুদ্ধ কাজ করছেন, তা চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিলো পাহাড়িদের ভূমির অধিকার রক্ষা, তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য পুনরুদ্ধার, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া শরণার্থীদের পুনর্বাসন, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার (স্থায়ী সামরিক স্থাপনা ব্যতীত), এবং আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের মাধ্যমে স্ব-সরকার।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পাহাড়িদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিলো।

এই চুক্তিটি আন্তর্জাতিকভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিলো এবং ১৯৯৯ সালে তাকে জাতিসংঘের শিক্ষামূলক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিলো।

এই ২২ বছরে বাংলাদেশ সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয় পাহাড়ের ভূমি সমস্যার সমাধানে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। উল্টো পাহাড়িদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলছেই। উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, পর্যটন সবই হয়ত দরকার আছে। বসতবাড়ি বা আবাদি জুম চাষের পাহাড় জমি থেকে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে উন্নয়ন বা অবকাঠামো নির্মাণ কতোটা জরুরি, সংবেদনশীলতার সঙ্গে তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

পাহাড়ে পর্যটন বিকাশের জন্যে নেওয়া উদ্যোগের বিরোধিতা করছি না। পাহাড়িরা তা করেন না। পর্যটনও বিকশিত হবে আবার পাহাড়ের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ হবে না, এমন একটি অবস্থায় পৌঁছানো অসম্ভব কিছু নয়। এর জন্যে প্রয়োজন সংবেদনশীলতা ও আন্তরিকতা। কাজটি পাহাড়িদের ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ না করেও করা সম্ভব।

উপনিবেশিক শাসনের অধীনে সুরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের জমি পুনরুদ্ধারের জন্য ২২ বছর আগে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিকে সম্মান না করলে পাহাড়ের সমাধান সম্ভব নয়।

দুই যুগেরও বেশি সময় সশস্ত্র যুদ্ধাবস্থার পরে, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পাহাড়িদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি এনেছিলো।

পাহাড়িরা প্রত্যাশা করেছিলেন কিছুটা স্বশাসন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার পাবেন। পাহাড়ের প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে পারবেন।

সরকার জুম্মদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যেখানে জমির সম্প্রদায়গত মালিকানাসহ তাদের সাংস্কৃতিক অনুশীলন সুরক্ষিত থাকবে।

বাস্তুচ্যুত পাহাড়িদের জমি ও আবাসন দিয়ে পুনর্বাসিত করার জন্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা অপরিহার্য ছিলো। তার জন্যে চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৯৯ সালে গঠিত ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা দরকার ছিলো। এতো বছর পরেও তা করা হয়নি। কমিশনকে অকার্যকর রেখে বারবার শুধু চেয়ারম্যান পরিবর্তন করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো অগ্রগতি হয়নি।

১৯৯৯ সাল থেকে কমিশনের কাছে প্রায় ২২ হাজার অভিযোগ জমা পরে আছে।

জুম্ম জনগণগোষ্ঠীকে বসতবাড়ি বা আবাদি জমি থেকে বঞ্চিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে বলে মনে হয় না।

Comments

The Daily Star  | English
Banks deposit growth in 2024

Depositors leave troubled banks for stronger rivals

Depositors, in times of financial uncertainty, usually move their money away from troubled banks to institutions with stronger balance sheets. That is exactly what unfolded in 2024, when 11 banks collectively lost Tk 23,700 crore in deposits.

12h ago