‘প্রথমে আমি সাংবাদিক তারপর দল, এখন হয়ে গেছে আগে দল পরে সাংবাদিক’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মোহাম্মদপুর ও নিকুঞ্জে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী,সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আহত-রক্তাক্ত হয়েছেন ৬ জন সাংবাদিক। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘আগামী নিউজ’-এর সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন।
Editors Collage.jpg
মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এবং ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মোহাম্মদপুর ও নিকুঞ্জে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী,সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আহত-রক্তাক্ত হয়েছেন ৬ জন সাংবাদিক। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘আগামী নিউজ’-এর সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন।

সিটি নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে আসেননি, নির্বাচন কমিশন আজ্ঞাবহ-আস্থাহীন প্রতিষ্ঠান। তারা সংবাদ কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সাংবাদিককে পেটানো হচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তা দেখছে! নির্বাচন কমিশনের অধীনের এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। সাংবাদিকদের সংগঠন, সাংবাদিকদের নেতারা প্রথমদিকে নীরব থাকলে, পরে তাদের কেউ কেউ মৃদুস্বরে কথা বলেছেন। দুএকটি মানববন্ধন করে বায়বীয় শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে সাংবাদিকদের সংগঠন। অথচ কারা সাংবাদিকদের আহত-রক্তাক্ত করেছে তা জানা অসম্ভব নয়, অজানাও নয়।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা হয়েছে মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এবং ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের।

মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, “আমি মনে করি, এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হামলা। এই ঘটনাটি এতোটাই দুঃখজনক যে- ভোটের দিন সাংবাদিকের ওপর হামলা করেছে, গুরুতর অবস্থায় আহত সাংবাদিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, কিন্তু হাসপাতালও তার জন্যে নিরাপদ নয়। সেখানে গিয়েও হামলাকারীরা হুমকি দিয়েছে, মামলা করলে জানে রক্ষা নেই।”

“বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এমনিতেই নানা চাপের মুখে। এই ঘটনা নতুন করে স্বাধীনতাহরণের ইঙ্গিত দেয়। আমি মনে করি, মুক্ত সাংবাদিকতার প্রথম শর্ত হচ্ছে মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণতন্ত্র না থাকলে মুক্ত সাংবাদিকতা আশা করা যায় না।”

এই হামলার ঘটনায় সাংবাদিক নেতা ও সংগঠনগুলোকে সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না। - “তারা সোচ্চারই তো না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের অস্তিত্ব আরও বড় রকমের সংকটে পড়বে।”

“নিজের কথা স্বীকার করতে হবে। আমরা, সাংবাদিক নেতারা কেউই সোচ্চার না। আমরা আসলে দলবাজ হয়ে গেছি। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখার চেষ্টা করি।”

তাহলে কি এই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই সাংবাদিকরা সোচ্চার নন? - “হ্যাঁ, এই কারণেই সাংবাদিকরা সোচ্চার নন। এটাই বাস্তব। আজ হয়তো যিনি সোচ্চার নন, কাল হয়তো আঘাত নিজেরও ওপরও আসতে পারে।”

“প্রথমে আমি সাংবাদিক, তারপর দল। এখন হয়ে গেছে আগে দল, পরে সাংবাদিক। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।”

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, “আমরা সবসময়ই বলেছি, সাংবাদিকদের যারা নির্বাচন কাভার করবেন তারা নির্বাচন কমিশন থেকে কার্ড সংগ্রহ করবেন। কমিশন যখন কাউকে নির্বাচন কাভার করার অনুমতিপত্র দেয় তখন সেই সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা কমিশনকে দিতে হবে। কারণ, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে।”

“রাজনৈতিক দল যারা নির্বাচনে অংশ নেয়- কী সরকারি দল বা বিরোধী দল- তাদের সংবাদ সংগ্রহ করা সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব। শুধু সাংবাদিকের নিরাপত্তা নয়, তার ক্যামেরা, গাড়ির নিরাপত্তাও নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। নির্বাচনে যারা অংশ নেন তাদেরও দায়িত্ব সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দেওয়া।”

“নির্বাচনকালে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা আহত হয়েছেন। আমি বলবো, এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা। নির্বাচন কমিশন সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমিও এও মনে করি, রাজনৈতিক দল যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তারাও যথাযথভাবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন নাই।”

“যে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতে সাংবাদিক আহত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন তাদেরকেই প্রথম দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে, তারা গণমাধ্যমবান্ধব কী না। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

“আমরা জেনেছি, ছাত্রলীগ সেই আক্রমণকারীকে চিহ্নিত করে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তারা যদি আক্রমণকারীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার না করে তাহলে তারা ব্যর্থ।”

সাংবাদিক নেতা-সংগঠনগুলোর কী ভূমিকা পালন করছে? - “আমি মনে করি সাংবাদিকদের রুটি-রুজি, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংগঠনগুলোর মৌলিক দায়িত্ব। সাংবাদিককে আহত করায় তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সংগঠনগুলোর এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া উচিত।”

আগেও তো এরকম হামলা হয়েছে। সেগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। সেই ধারাবাহিকতাই কি চলছে? - “ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডমের মানদণ্ডে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ‘আংশিক স্বাধীন’। অর্থাৎ, এদেশে সাংবাদিকদের হত্যা করা হলে বা নির্যাতন করা হলে এর কোনো বিচার হয় না। এটি যেমন সাংবাদিকদের জন্যে লজ্জার, তেমনি রাষ্ট্রের জন্যেও লজ্জার। কারণ, একটি দেশ সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না।”

“আমরা বরাবরের মতো সব সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার দাবি করছি।”

শ্যামল দত্ত বলেছেন, “গণমাধ্যমের ওপর এর আগেও আঘাত এসেছে, কোনোটিরই বিচার হয়নি। এ ব্যাপারে আমরা কারো কোনো আন্তরিকতা দেখি না। না সরকারের, না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।”

“এবার আমরা দেখেছি, সাংবাদিকদের ওপর অনেকে মারমুখো ছিলো। নির্বাচনী প্রচারণার সময় দুটি ঘটনায় সাংবাদিকরা আহত হয়েছিলেন। পরে নির্বাচনের দিনেও ছয়জন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন।”

“প্রেসক্লাবে যখন সব মেয়র প্রার্থীরা এসেছিলেন, তাদের সবার সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় আমরা তাদের সবার কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম যাতে সাংবাদিকরা নির্বিঘ্নে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। সেই পরিবেশটা যেনো তারা অক্ষুণ্ণ রাখেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক আহত হয়েছেন।”

“আমরা গণমাধ্যমের মুক্ত পরিবেশের কথা বলি, সেটি যাতে বজায় থাকে সেই চেষ্টা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে আরও সচেষ্ট হয়, যারা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের যেনো বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়- সেই প্রত্যাশা করবো।”

“গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ- সেটি যাতে বজায় থাকে।”

সাংবাদিক নেতা, সংগঠনগুলোকেও সরব দেখা যাচ্ছে না। - “কারণ, সংগঠনগুলো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। সত্যি বলতে কী, সাংবাদিকদের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নিয়ে কোনো কর্মতৎপরতা দেখি না। তারা ট্রেড-ইউনিয়নিজমে ব্যস্ত। সাংবাদিকদের রুটি-রুজির কল্যাণ করা, বা পেশাদারিত্বের জায়গায় আরও ভূমিকা রাখার কাজটি হয় না। এটা আমাদের জন্যে খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়।”

গতরাতে পুলিশের বিশেষ শাখার এক উপপরিদর্শককে মারধরের মামলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক নবনির্বাচিত কাউন্সিলরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ, ১ ফেব্রুয়ারি মারধরের ঘটনায় কাউকে এখন পর্যন্ত আটক করা হলো না। - “হ্যাঁ, যেহেতু সেই কাউন্সিলর পুলিশের বিশেষ বাহিনীর ওপর হামলা করেছে তাই তাৎক্ষণিকভাবে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। অথচ, সাংবাদিক মারধরের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। আমরা মনে করি, পুলিশকে তৎপর হয়ে সাংবাদিককে আহত করার বিষয়টি দেখা উচিত।”

আপনারা তো বিভিন্ন সময় বড় বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন কি এ বিষয়টি তুলে ধরেন? - “আমরা তো বলি। যেমন, ওই যে মেয়র প্রার্থীদেরকে বললাম। কিন্তু, কোনো লাভ তো হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও বলেন, ‘দেখছি, ব্যবস্থা নিবো।’ আমার মনে হয়, তাদের প্রায়োরিটির মধ্যে এটি নেই।”

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago