খাল খনন কাজ বন্ধ করে দিলেন আ. লীগ নেতা

প্রধানমন্ত্রী গৃহীত ডেল্টা প্ল্যানের অংশ হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের পদ্মানদী থেকে আড়িয়াল খাঁ নদের সংযোগ খাল পুনঃখনন প্রকল্পটি গ্রহণ করে।
২৯ জানুয়ারি রাতে চরভদ্রাসন উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ খান তার দলবল নিয়ে খনন কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেসময় খনন কাজে নিয়োজিতদের ভয়ভীতি দেখানো হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
খাল খননকাজে নিয়োজিত এক্সকেভেটর চালক নাসির মোল্লা, আনোয়ার হোসাইন ও সাইডের সাব-ঠিকাদার জিন্নাত ফকির এ অভিযোগ করেছেন।
জিন্নাত ফকির জানিয়েছেন, কাজ বন্ধ থাকায় পাঁচটি এক্সকেভেটর মেশিন বাবদ প্রতিদিন তাদের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। এই কাজ শুরু না হলে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন বাড়তেই থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. ইকবাল হোসেন বলেছেন, “আগামী দুই মাসের মধ্যে কাজটি শেষ করতে না পারলে বর্ষা মৌসুমে এই কাজ করা সম্ভব হবে না। তখন পদ্মার পানি বেড়ে যাবে। খালে পানি থাকার কারণে খনন কাজ করা যাবে না।”
তার মতে, এখন পর্যন্ত যতোটুকু কাজ হয়েছে তাও নষ্ট হয়ে যাবে। মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার বিষয়ে আশঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, ওই প্রকল্পের অধীনে ৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা খরচে হরিরামপুর ইউনিয়নে পদ্মানদী থেকে জাকেরের সুরা হয়ে পার্শ্ববর্তী সদরপুর উপজেলার আকটের চর ইউনিয়নের রামনগর এলাকায় আড়িয়াল খাঁ নদ পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি খননের কাজ পায় মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর পাঁচটি বড় এক্সকেভেটর মেশিন দিয়ে খাল খননের কাজ শুরু করা হয়। প্রায় দেড় কিলোমিটার খননের পর গত ২৯ জানুয়ারি রাতে কাজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল কালাম আজাদসহ ২১জন বাদী হয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পাউবো ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সহ ১৫ জনকে বিবাদী করে একটি রিট করেন হাইকোর্টে।
বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ গত ২৯ জানুয়ারি রিটের শুনানি শেষে রিটকারীদের সঙ্গে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা ও তাদের বিরক্ত না করার নির্দেশ দেন।
উচ্চ আদালত খাল খনন কাজ বাস্তবায়নে কোনো স্থগিতাদেশ না দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করেই আবুল কালাম আজাদ সেদিন রাতে দলবল নিয়ে এসে কাজটি বন্ধ করে দেন।
এব্যাপারে আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, “এ কাজ বন্ধ করেছেন হাইকোর্ট।”
তিনি আরও বলেন, “যে এলাকায় খাল খনন করা হচ্ছে ওখানে আগে খাল ছিলো। বর্তমানে খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। খাল খননের ফলে অন্তত ৭৭ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি কাটা যাচ্ছে।”
“খাল খননে আমাদের আপত্তি নেই। এই খনন কৃষক বা এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসবে না। আমরা আমাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ক্ষতিপূরণ চাই। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে আমরা খাল কাটতে দিবো,” যোগ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা।
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেছেন, “সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে খালের জমি নির্ণয় করে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেওয়ার পর ঠিকাদার কাজ শুরু করেছেন। যখন ওই লাল পতাকা টাঙানো হয়েছিলো তখনই তারা আপত্তি জানাতে পারতেন। কাজের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শেষ হওয়ার পর এখন কাজ বন্ধ করে দেওয়া মানে প্রকল্পটির ভবিষ্যতই অনিশ্চিত করে দেওয়া।”
এব্যাপারে গত সোমবার সরেজমিনে এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপকালে তারা স্থানীয় কৃষি ও নৌযোগাযোগসহ নানা সুবিধার্থে খালটি খনন করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন।
হরিরামপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মো. মোসলেমউদ্দিন খান বলেছেন, “দীর্ঘদিন পলি জমার কারণে খালটি ভরাট হয়ে গিয়েছিলো। এখন পুনঃখনন করা হলে এলাকাবাসী এতে অনেক উপকৃত হবে।”
হরিরামপুরের কৃষক সামসুল বেপারী বলেছেন, “খালটি খনন করা হলে আশেপাশের ইরি ব্লকে পানি দেওয়া সহ পাট জাগ দিতে সুবিধা হবে। কৃষকেরা কম খরচে নৌপথে তাদের ফসল আনা-নেওয়া করতে পারবে।”
চরভদ্রাসন সদরের মৌলভীর চরের বাসিন্দা মো. হারুন মুন্সি (৬৫) বলেছেন, “ছোটবেলায় এই খালে লঞ্চ চলতে দেখেছি। আমরা এই পথেই যাতায়াত করতাম। খালটি খনন করা হলে এলাকাবাসী কৃষিকাজসহ নানা দিক দিয়েই উপকৃত হবেন। খাল খননের এই কাজটি যেনো বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।”
ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা বলেছেন, “সরকারি কাজে কেউ বাধা দিতে পারে না। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ তুলতে পারে।”
“হাইকোর্টতো খাল খননে স্থগিতাদেশ দেননি। হাইকোর্ট আলোচনা করতে বলেছেন,” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “কেনো খাল খনন কাজ বন্ধ করা হলো সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
Comments