হঠাৎ করে আসেনি এই সাফল্য

মতামত

এই প্রথম অভাবনীয় এক সাফল্য নিয়ে এসেছে যুব ক্রিকেট দল। সমস্যায় জর্জরিত জাতির জীবনে হুট করেই এসেছে বিপুল আনন্দের উপলক্ষ। সামগ্রিকভাবে অনেককিছুর মতোই বাংলাদেশের ক্রিকেটেও আলোচনার বিষয় ‘দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাহীনতা‘। আছে আরও নানাবিধ সংকট। কিন্তু স্রোতের প্রতিকূলের যাত্রীর বেশে আকবর আলিরা যে রীতিমতো বিশ্বকাপ জিতে গেলেন তা কি আচমকাই এল? সেরার মুকুট পরার পর অনেকেরই কৌতূহল বাংলাদেশের এই দলটিকে নিয়ে। কিন্তু যদি বলা হয়  আকবররা এই দিনটিতে আসার জন্য হাঁটা শুরু করছিলেন সেই ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাস থেকে, তাহলে হয়ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়বে।  

রোববার দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে ভারতকে হারিয়ে যখন খ্যাপাটে উল্লাসে দুনিয়া কাঁপাচ্ছেন বাংলাদেশের উনিশের ছেলেরা, বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলছে ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু যারা বাংলাদেশের এই ছেলেদের গত দুই বছরের প্রস্তুতি সম্পর্কে খবর রেখেছেন, দেখেছেন তাদের এগুনোর প্রক্রিয়া। তারা নিশ্চিত অবাক হননি, তালি দিয়েছেন। 

বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে একাধিক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর বলছিলেন, অন্তত এবার তারা ফাইনাল খেলতে চান। সেটা যে বলার জন্য বলা কোন কথা না, বুঝিয়ে দেন আত্মবিশ্বাসী গলার স্বরেও। দল হয়ে উঠে আকবররা নিজেদের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন, দেশকে তুলেছেন চূড়ায়। কিন্তু তাদের পেছনের গল্পটাও তো মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি।

ইতিহাসের সেরা প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বকাপে

দু’বছর পর পর আইসিসি আয়োজন করে যুব বিশ্বকাপ। গড়পড়তা প্রস্তুতিতে এই আসরে অংশ নিয়ে আসছে বাংলাদেশ। হান্নান সরকার, নাফিস ইকবাল থেকে শুরু করে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমরা, মেহেদী হাসান মিরাজরা খেলেছেন এই আসরে। আশা জাগিয়েছেন। কিন্তু সেমিফাইনালের বেশি এগুতে পারেনি কোন দলই। 

এবার বাংলাদেশ শুরু থেকেই ভাবনাটা রেখেছে চূড়ায়। তাই প্রস্তুতিটাই ছিল আলাদা ধাঁচের। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিসিবির গেম ডেভপালাপমেন্ট কমিটি তুখোড় পরিকল্পনা করেই নিয়ে এসেছে এমন সাফল্য। বিসিবিতে ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি যেমন দেখভাল করে জাতীয় দলের, তেমনি গেম ডেভলাপমেন্ট কমিটির দায়িত্ব বয়সভিত্তিক দলগুলোকে শান দিয়ে তৈরি করা। অনূর্ধ্ব-১৩, ১৫ , ১৭ ও ১৯ দলের খেলোয়াড় সংগ্রহ, যাবতীয় প্রস্তুতি, ম্যাচ পরিকল্পনার ভার তাদের উপরই ন্যস্ত। 

এই কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম বড় কোন জয়ের নায়ক সুজন। তবে খেলোয়াড়ি জীবন ছাড়ার পর সংগঠকের ভূমিকায় একই সঙ্গে নন্দিত এবং নিন্দিত তিনি। হরহামেশায় তাকে ঘিরে অনেক রকম সমালোচনা, ফেসবুক ট্রল হয়েই থাকে। তার কিছু কিছুর নায্য গ্রাউন্ডও খুঁজলে মিলবে। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতা অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে প্রস্তুত করতে তিনি ও তার কমিটি যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা নির্মোহ দৃষ্টিতে বড় বাহবা পাওয়ার যোগ্য।  

২০১৮ সাল থেকেই তারা পরিকল্পনা করছিলেন ২০২০ যুব বিশ্বকাপ ঘিরে। এই বিশ্বকাপে সেরা প্রস্তুতি নিয়ে দল পাঠাতে দেশে ও দেশের বাইরে আয়োজন করা হয় সাতটি দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিদেশীয় সিরিজ। বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত এই সময়ে বাংলাদেশের ছেলেরা ৩৬টি যুব ওয়ানডে খেলেছে, জিতেছে ২১টিতে, হেরেছে মাত্র ৮ ম্যাচ। টাই হয়েছে এক ম্যাচ। ফল হয়নি তিন ম্যাচে, পরিত্যক্ত হয়েছে বাকি তিন ম্যাচ।

বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া আর কোন দল এত ম্যাচ খেলেনি। এমনকি ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে হারা ভারতের যুবারাও খেলেছে ৩১ ম্যাচ, শ্রীলঙ্কা ৩০ ম্যাচ। বাকিরা বেশ খানিকটা পিছিয়ে। শুরুর দিকে যুবাদের পারফরম্যান্স ছিল গড়পড়তা। কিন্তু প্রচুর ম্যাচ খেলার ফলে শেষে তারা হয়ে উঠেন দুর্বার। ইংল্যান্ডে গিয়ে এই দল হারায় ইংল্যান্ডে, নিউজিল্যান্ডে গিয়ে উড়িয়ে দেয় ওদের।  

বিশ্বকাপ ঘিরে বানানো হয়েছিল ৩০ জনের একটা পুল। ঘুরেফিরে এই পুলের ক্রিকেটাররাই খেলেছেন গত দুই বছর। কেবল ম্যাচ খেলানোই নয়, বিশ্বকাপে যাদের ঘিরে স্বপ্ন, তাদের একসঙ্গে রেখে করানো হয়েছে কোচিং, বাড়ানো হয়েছে একাত্মবোধ। নিয়মিত সব কোচের সঙ্গে ফিটনেস বাড়াতে দলের সঙ্গে গত এক বছর থেকে কাজ করেছেন স্টেন্থ ও কন্ডিশনিং কোচ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সিনিয়র-জুনিয়র কোন পর্যায়ের কোন দলই এতবেশি প্রস্তুতির সুযোগ পায়নি। এমন সেরা প্রস্তুতি নিয়ে যদি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিততে না পারত, তাহলে সেটাই হতো হতাশার। পৃথিবীতে আচমকা,অযৌক্তিক কোন কিছু হয় না। সব কিছুর পেছনেই থাকে যৌক্তিক কারণ। 

শঙ্কার জায়গা যেখানে 

অমন দুনিয়া মাত করা সাফল্যের পর শঙ্কার জায়গা থাকার কথা না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা যে ভিন্ন। একটু উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। 

বিশ্বকাপ হারা ভারতের লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণোই এরপরের ক’বছর যে প্রক্রিয়ার মধ্যে তার ক্যারিয়ার এগিয়ে নেবেন, বিশ্বকাপ জয়ী রকিবুল হাসানও কি পাবেন তেমন ব্যবস্থা? যদি না হয় তাহলে এই সাফল্য হয়ে থাকবে কেবলই ক্ষণিকের আনন্দ। 

ভারতের শিখর ধাওয়ান আর বাংলাদেশের আফতাব আহমেদ একই আসরে যুব বিশ্বকাপ খেলেন। শিখর এখন দুনিয়া সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যানদের একজন। আর আফতাব খেলা টেলা ছেড়ে করাচ্ছেন ঘরোয়া কোচিং। ২০০৮ সালে একই যুব বিশ্বকাপে খেলেছিলেন ভারতের বিরাট কোহলি, বাংলাদেশের মোহাম্মদ মিঠুন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুজনের অবস্থান আজ কোথায়, এই কথা বুঝিয়ে বলা অনর্থক। 

যুব দল থেকে জাতীয় দলে আসার প্রক্রিয়া যদি ঠিক না থাকে। আজকের আকবর ভবিষতের মহেন্দ্র সিং ধোনির পর্যায়ে যেতে পারবেন তো?

দল গঠনের প্রক্রিয়া 

যে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ, যুব বিশ্বকাপে আছে তাদের সর্বোচ্চ চারটি ট্রফি। কিন্তু তারা এই বিশ্বকাপটাকে কেবল এই বিশ্বকাপের সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠিতে দেখে না। সততার সঙ্গে আগামীর দিকে নিবদ্ধ থাকে তাদের চোখ। 

ভারতে যুব পর্যায়ে কোন ক্রিকেটার তাদের বয়স গোপন করার চেষ্টা করলেই নিষিদ্ধ হন। অর্থাৎ সাফল্য পাওয়ার নেশায় কোনভাবেই ১৯ বছরের বেশি কাউকে তারা দলে রাখে না। রাহুল দ্রাবিড় গেম ডেভলাপমেন্টে যুক্ত হওয়ার পর নিয়ম চালু করেছেন কোন ক্রিকেটারই দুটি যুব বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না। বাংলাদেশের মেহেদী হাসান মিরাজ দুটি যুব বিশ্বকাপ খেলছেন, একই রকম দুই যুব বিশ্বকাপে ছিলেন সাইফ হাসান। এবারের দলে থাকা তৌহিদ হৃদয়ও খেলেছেন দুই বিশ্বকাপ। 

ভারত কঠোরভাবেই এই নিয়ম চালু রেখে এনেছে সুন্দর ও স্থায়ী একটা ব্যবস্থাপনা। প্রতিবছর খেলোয়াড় আসার স্রোতও বেড়েছে অনেক। আজকের এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকেও হাঁটতে হবে সে পথে। না হলে ক’বছর পর আকবর, রকিবুলদের সম্ভাবনা আটকে থাকবে তাদের পূর্বসূরিদের মতই।

Comments

The Daily Star  | English
Banks deposit growth in 2024

Depositors leave troubled banks for stronger rivals

Depositors, in times of financial uncertainty, usually move their money away from troubled banks to institutions with stronger balance sheets. That is exactly what unfolded in 2024, when 11 banks collectively lost Tk 23,700 crore in deposits.

13h ago