কত বড় মানুষ একজন সোইনউদ্দিন!

নাগরপুর উপজেলার ধুবুরিয়া ইউনিয়নের চকগাধর গ্রামের দরিদ্র কৃষক মোহাম্মদ সোইনউদ্দিন মিয়া। গ্রামবাসীদের দীর্ঘ দিনের দুর্ভোগ দূর করার জন্য প্রবল ইচ্ছায় চার বছর ধরে অক্লান্ত শ্রম দিয়ে তৈরি করেছেন দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ মাটির রাস্তা।
নিজের তৈরি করা রাস্তায় সোইনউদ্দিন। ছবি: স্টার

নাগরপুর উপজেলার ধুবুরিয়া ইউনিয়নের চকগাধর গ্রামের দরিদ্র কৃষক মোহাম্মদ সোইনউদ্দিন মিয়া। গ্রামবাসীদের দীর্ঘ দিনের দুর্ভোগ দূর করার জন্য প্রবল ইচ্ছায় চার বছর ধরে অক্লান্ত শ্রম দিয়ে তৈরি করেছেন দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ মাটির রাস্তা।

চাকগাধর টাঙ্গাইলের নগরপুর উপজেলার অন্যতম সুবিধাবঞ্চিত গ্রাম। রাস্তার সংযোগ না থাকায় কার্যত মূল ভূখণ্ড থেকে এটি অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।

সোইনউদ্দিন বলেন, “আমি জমি, শ্রম এবং টাকা খরচ করে রাস্তাটি বানিয়েছি। গ্রামবাসীরাও তাদের জমি দিয়ে এ কাজে আমাকে সহায়তা করেছেন।”

এই গ্রামের বাসিন্দারা স্থানীয় বাজারে যেতে সোইনউদ্দিনের বাড়ির পাশে দিয়ে যাওয়া একটি চিকন আইল ব্যবহার করতেন বড় রাস্তায় উঠতে। প্রায় দেড় কিলোমিটার এই আইলটিই গ্রাম থেকে বের হওয়ার এবং শিশুদের স্কুলে যাওয়ার একমাত্র উপায়।

বর্ষাকালে আইলটি কোমর পানির নিচে তলিয়ে যায়। যাতে দুর্ভোগে পড়তেন গ্রামের অধিবাসীরা। সহজ কোনো বিকল্প পথ না থাকায় তাদের ব্যবহার করতে হতো নৌকা। কিংবা পানিতে ভিজেই পার হতে হতো এই পথটুকু।

সোইনউদ্দিন আরও বলেন, “আমি রাস্তাটি তৈরি করার পর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কিছুটা সহযোগিতা করে রাস্তাটি একটু উঁচু করার জন্য কিছু শ্রমিক দিয়েছিল। কিন্তু এটা যথেষ্ট না। বর্ষাকালে যাতে রাস্তাটি নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য এটিকে আরও উঁচু করতে হবে।”

“তবে, রাস্তাটি একটি আকার পেয়ে গেছে। ইজিবাইক, গাড়ি, মাইক্রোবাসের মতো হালকা যানবাহন এই রাস্তায় চলতে পারে। আমার পরিশ্রমকে স্বার্থক করতে চাইলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এটাকে সহজেই পাকা করতে পারে।

আমার যতটা সাধ্য ছিল তা করেছি। কিন্তু, রাস্তাটি নিয়ে দুশ্চিন্তা আমার শেষ হয় না। এটা পাকা হলে আমি ভালোভাবে ঘুমাতে পারব।”

যোগাযোগ করা হলে ধুবুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, “কৃষক সোইনউদ্দিন একটি অনন্য কাজ করেছেন। আমরা তার জন্য গর্বিত। দেরিতে হলেও আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কিছু শ্রমিক দিয়ে এই কাজে কিছুটা সহায়তা করেছি। এখন এই মাটির রাস্তাটি পাকা করতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলব।”

সাইনুদ্দিনের স্ত্রী লাকী বেগম জানান, তার স্বামী সারাদিন নিজের কৃষি জমিতে কাজ করার পর মাঝরাত পর্যন্ত রাস্তাটি বানানোর জন্য একা কাজ করেছেন।

পরে, তিনি তার ভাইদের এই কাজে সঙ্গে নেন। তিনি রাস্তার কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য শ্রমিকও নেন।

লাকি বলেন, “সোইনউদ্দিন রাস্তাটি বানানোর জন্য কী করেননি? আমরা বছরের পর বছর ধরে খাওয়ার জন্য যে ধান জমিয়েছি তাও সে বিক্রি করে দিয়েছে। রাস্তার জন্য মাটি নিতে তিনি তার ফসলি জমিকে পুকুর বানিয়ে ফেলেছেন। রাস্তা বানানোর জন্য জমি নিতে দিনে পর দিন তিনি গ্রামবাসীর দারে দারে ঘুরেছেন, হাতে পায়ে ধরেছেন।”

“আমার স্বামী তার সাধ্যমত সবই করেছেন। এখন সরকারের উচিত এটাকে পাকা রাস্তায় পরিণত করা,” তিনি যোগ করেছেন।

সোইনউদ্দিন জানান, “আমি গ্রামবাসীর সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েছি। জনপ্রতিনিধিদের কাছেও গিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি।”

আর্থিক সামর্থ্য না থাকা সোইনউদ্দিন এক জোড়া হাতের ওপর নির্ভর করেন। সরু আইলকে তিনি পাঁচ ফুট থেকে সাত ফুট প্রশস্ত এবং তিন ফুট থেকে চার ফুট উঁচু রাস্তায় পরিণত করার কাজ শুরু করেন।

এমন বড় একটি কাজ করেও বিনয়ের সঙ্গে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমি কেবল গ্রামবাসীর জন্য রাস্তাটি বানাইনি। আমার পরিবারের সদস্যরাও এই রাস্তার সুবিধা পাচ্ছে।”

কিন্তু গ্রামবাসীরা বারবারই বলেছেন তার দৃঢ় সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রমের কারণেই এই রাস্তাটি বানানো সম্ভব হেয়েছে।

গ্রামের একজন বাসিন্দা আবু সাইদ বলেন, “সোইনউদ্দিন ভাই বড় মনের মানুষ। তিনি কয়েক বছর ধরে শুধু কঠোর পরিশ্রমই দেননি, নিজের জমিও দিয়েছেন। রাস্তার জন্য নিজের জমি থেকে প্রচুর পরিমাণে মাটিও নিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, এখন এই রাস্তা দিয়ে মালামাল সহ রিকশা-ভ্যানের মতো হালকা যানবাহন সহজেই চলতে পারে।

১৫০০ গ্রামবাসীর চলাচলের জন্য এই রাস্তাটি গত বছর মে মাসে খুলে দেওয়া হয়।

সোইনউদ্দিনের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (১৯) বলেন, “বাবা যা করেছেন তাতে আমরা গর্বিত। আমার বাবা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পান নি। তবে তিনি অনেক শিক্ষিত মানুষের থেকে চিন্তাভাবনায় অনেক বেশি উন্নত।”

রাস্তার উন্নয়নের বিষয়ে কথা বলা হয় নাগরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফয়েজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, সোইনউদ্দিন বা অন্য গ্রামবাসীর কাছে থেকে আবেদন পেলে তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago