‘মেড ইন বাংলাদেশ’ স্মার্টফোন বিপ্লব

ডিজিটালাইজেশন যাত্রায় সদ্য পেরিয়ে আসা দশকটাকে বহুকাল পরেও বাংলাদেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে কয়েকটি কারণে।
ছবি: সংগৃহীত

ডিজিটালাইজেশন যাত্রায় সদ্য পেরিয়ে আসা দশকটাকে বহুকাল পরেও বাংলাদেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে কয়েকটি কারণে।

একটি হলো এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশ স্মার্ট ডিভাইস তৈরির কাজে হাত দিয়েছিলো। আর মাত্র দুই আড়াই বছরের মধ্যে ’মেড ইন বাংলাদেশ’কে একেবারে প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছে মাত্র কয়েকজন উদ্যোক্তা।

অথচ বছর কয়েক আগেও কি কেউ চিন্তা করেছিলেন বাংলাদেশের কোনো কারখানায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মোবাইল ফোন সংযোজিত হবে? আবার সেটির দাম এবং মানও হবে আমদানিকৃত ডিভাইসের চেয়ে সেরা!

কল্পনার বাইরে থেকে সেই স্বপ্নকে বাস্তবতা দিয়ে এখন বেশ কয়েকটি কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেছে যারা আর কোনো ডিভাইস-ই আমদানি করছে না। কী বেসিক ফোন বা সর্বাধুনিক ক্ষমতার স্মার্টফোন সবাই তৈরি করছেন ঢাকা, গাজীপুর বা নরসিংদীর কারখানায়।

কেউ কেউ আছেন এখন শুধু স্মার্টফোন তৈরি করছেন আর প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন যাতে তাদের সমস্ত চাহিদাই দেশীয় কারখানা থেকে মেটাতে পারেন।

২০১৭ সালের অক্টোবরে ওয়াল্টন দিয়ে শুরু হয়েছিলো। একে একে এখানে নয়টি কারখানা হয়ে গেছে। তালিকায় আছে স্যামসাংয়ের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড। আছে বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পাওয়া চাইনিজ ব্র্যান্ড আইটেল এবং টেকনো। দেশীয় ব্র্যান্ড সিম্ফোনিও কম যায় না।

গত বছরই কারখানা করে ফেলেছে দুটি জনপ্রিয় চাইনিজ ব্র্যান্ড ভিভো এবং ওপ্পো। দেশীয় ফাইভ স্টার ব্র্যান্ড যেমন নিজেদের কারখানা করে সফলতা পেয়েছে তেমনি উনম্যাক্সও বেশ ভালো করেছে। অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে হুয়াওয়ে বা মটোরোলার মতো ব্র্যান্ডও।

একটা সময় ছিলো, যখন ভালোমানের মোবাইল ফোনের জন্য ক্রেতারা ‘মেইড ইন ফিনল্যান্ড’ বা ‘মেইড ইন কোরিয়া’ খুঁজতেন। এরপর সেই জায়গাটি নিয়ে নেয় ‘মেইড ইন চায়না’ এরপরে আসে ‘মেইড ইন ভিয়েতনাম’। এখন এই ট্যাগ লাইনে জ্বলজ্বলে নাম ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’।

প্রথমদিকে ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরণের জড়তা ছিলো। কিন্তু, এর সবই কেটে গেছে এখন। হ্যান্ডসেটে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং বলতে মিডিয়াতে কিছু রিপোর্ট। এর বাইরে বলতে গেলে হ্যান্ডসেটগুলোর ব্যবহারকারীরাই এর মানের কথা লোকমুখে প্রচার করেছে বেশি। আর তাতেই আসল কাজটা হয়ে গেছে।

বলতে গেলে মাত্র দুই বছরেই বাংলাদেশ স্মার্টফোন উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।

২০১৯ সালে দেশে যতো স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে তার ৬২ শতাংশ উৎপাদিত হয়েছে বাংলাদেশে স্থাপিত কোনো না কোনো কারখানা থেকে। আর চলতি বছরের মধ্যে বাজারে স্মার্টফোনের চাহিদা দেশীয় কারখানা থেকেই সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলেও বলছেন স্থানীয় মোবাইল কারখানার মালিকরা। নিশ্চিতভাবে এ আমাদের জন্যে বড়ই সুখের সংবাদ।

গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বছরে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখ পিস স্মার্টফোন বিক্রি হয় দেশে। এর মধ্যে গত বছর দেশের বিভিন্ন কারখানায় সব মিলে ৫৪ লাখ স্মার্টফোন সংযোজিত হয়েছে। আরও প্রায় ২৪ লাখের মতো স্মার্টফোন হয় বৈধ পথে আমদানি হয়েছে নয়তো অবৈধভাবে দেশে ঢুকেছে। ২০২০ সালে এর পুরোটাই দেশে উৎপাদিত হতে যাচ্ছে বলে তাদের বিশ্বাস।

এই খাতটির সঙ্গে কাজ করা একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখছি খাতটির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সেই হিসেবে তাদের বিশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখতে চাই।

যেভাবে স্যামসাং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকেই তাদের সর্বোৎকৃষ্ট প্রযুক্তিসম্পন্ন স্মার্টফোন সিরিজ ‘নোট’ দেশের কারখানায় সংযোজন করবে, সে কথা তারা রেখেছে। এটি এখন গোটা বাংলাদেশকে গর্ব করার খবর। বিদেশি গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে এই খবর।

স্যামসাং এখন তাদের স্থানীয় চাহিদার ৯৭ শতাংশই নরসিংদীর কারখানায় উৎপাদন করছে।

যাত্রার মাত্র এক বছরের মধ্যে দুটি ব্র্যান্ড – টেকনো এবং আইটেল – এর চাহিদার পুরোটাই নিজেদের কারখানায় সংযোজন করে সাড়া ফেলেছে। ওয়াল্টনও দুই বছর হয়ে যাচ্ছে আর কোনো সেট আমদানি করছে না। এই খবরগুলো আমাদেরকে গর্বিত করছে।

কিন্তু, যখন পেছন ফিরে কেউ জানবেন যে, ২০০৭ সালে স্যামসাং আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো বাংলাদেশে একটি কারখানা করতে। কিন্তু, নানা কারণে সেটি তারা করতে না পেরে চলে গেছে ভিয়েতনামে। এরপর ভিয়েতনামে একে একে তারা তিনটি কারখানা করেছে। গত বছর পর্যন্ত বছরে ১৪ কোটির কাছাকাছি স্মার্টফোন তৈরি হয়েছে স্যামসাংয়ের ওই কারখানাগুলো থেকে।

আর চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন তো ভিয়েতনাম পেয়ে গেলো আরও গতি। এখন গোটা বিশ্বে স্যামসাংয়ের যে চাহিদা তার অর্ধেকটার বেশি জোগান দেওয়া হচ্ছে এই দেশটি থেকে।

সুখের ঢেকুর তোলার বিপরীতে এটিই হতে পারে আমাদের জন্যে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া এক হতাশা।

এখানে যে জিনিসটা বলতে চাই, হয়তো এক যুগ আগের সেই ট্রেন আমরা মিস করেছি কিন্তু, যে ট্রেনটি শেষ পর্যন্ত আমরা ধরতে পারলাম সেটির গতি কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেদিকেও তাকাতে হবে আমাদের।

প্রথম কাজ গত বাজেটেই করা হয়েছে, স্মার্টফোনের আমদানি কর বাড়িয়ে ৫৭ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কারখানা স্থাপনে সবাই-ই বেশ গতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এখন যদি মানের দিকে একটু নজর দেওয়া হয় তাহলে সেটি আরও কাজের হবে নিশ্চয়ই।

আমরা জেনেছি ইতিমধ্যে কোনো কোনো উদ্যোক্তা মোবাইল সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অ্যাক্সেসরিজ তৈরির জন্যেও কারখানা তৈরির কাজে হাত দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ব্যাটারি-ফোনের কেসিং-চার্জারসহ নানা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের চাহিদা দেশীয় কারখানা থেকেই আসতে পারে।

কে বলতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি যেভাবে গার্মেন্টসের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে একসময় সেখানে যে মোবাইল হ্যান্ডসেটও বড় ভূমিকা রাখবে না?

নিজ নিজ কারখানা থেকে রপ্তানির কথা বলছেন সবাই-ই। সবাই না পারুন অন্তত কয়েকজনও যদি দু-এক বছরের মধ্যে কাজটা শুরু করতে পারেন, হয়তো দিন বদলে হাতিয়ার এই মোবাইল ডিভাইস ইন্ড্রাস্ট্রি হয়ে যেতে পারে।

শুধু মোবাইল ডিভাইস কেন, ল্যাপটপেও আমরা দেখছি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ। একটু-আধটু করে হলেও রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে এই ডিজিটাল ডিভাইসটিও।

আমরা এখন সেই দিনেরই অপেক্ষায় আছি যেদিন ইউরোপ-আমেরিকায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা শার্ট বা ডেনিমের মতো করে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা মোবাইল ডিভাইসও মিলবে।

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago