‘ধনীরা রাজনীতি কিনে নিয়েছেন’

আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে ‘নয়-ছয়’ কার্যকর হতে যাচ্ছে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদ হবে নয় শতাংশ এবং ব্যাংকে আমানত রাখলে পাওয়া যাবে ছয় শতাংশ সুদ। সরকারের এই ‘নয় ছয় সুদনীতি’র ভালোমন্দ দিক, দেশের আর্থিকখাতের প্রকৃত অবস্থা, নতুন সুদনীতির মাধ্যমে সরকারের আশা শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার এবং এতে মধ্যবিত্তের লাভ-লোকসান কী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ (বামে), অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে ‘নয়-ছয়’ কার্যকর হতে যাচ্ছে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদ হবে নয় শতাংশ এবং ব্যাংকে আমানত রাখলে পাওয়া যাবে ছয় শতাংশ সুদ। সরকারের এই ‘নয় ছয় সুদনীতি’র ভালোমন্দ দিক, দেশের আর্থিকখাতের প্রকৃত অবস্থা, নতুন সুদনীতির মাধ্যমে সরকারের আশা শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার এবং এতে মধ্যবিত্তের লাভ-লোকসান কী? — এসব নিয়ে গতকাল সোমবার দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “সুদের হার কমিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি আমি দেখি না। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত বা যাদের স্বল্প আয় বা ফিক্সড ইনকাম তাদের সুবিধা দিতে হবে। তারা সঞ্চয় করবেন এবং পাশাপাশি এর ভালো রিটার্ন পাবেন। তার টাকা সুরক্ষিত থাকবে। এটাই হওয়া উচিত সরকারের নীতি। বাস্তবে হচ্ছে উল্টো।”

“সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত মোটেও যুক্তিসঙ্গত হয়নি। প্রথমত, সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। সরকার এতো ধার করবে কেন? বাজেটে ঘাটতিই বা হবে কেন? সমস্যার মূলে যেতে হবে। সর্বশেষ ডাকঘর সঞ্চয়পত্র স্কিমের সুদের হার কমানো হয়েছে। এটা সবচেয়ে সুরক্ষিত ছিল। ডাকঘর প্রাচীন একটি সংস্থা। গ্রামের মানুষ বেশি ব্যবহার করেন। ডাকঘর সঞ্চয়পত্র স্কিমের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত মোটেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত হয়নি। এখানে অর্থনীতির কোনো যুক্তি খাটানো যাবে না।”

কিন্তু, দেশের উন্নয়ন নিয়ে তো অনেক কথা হচ্ছে।

“একটা দেশের উন্নয়ন কীসের জন্যে? উন্নয়ন কি শুধু প্রবৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি দিয়ে হয়? মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হবে। মানুষকে সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। মানুষ আয় থেকে সঞ্চয় করে। সেটা যেন কমে না যায়। গরিবের তো গাড়ি-বাড়ি নেই। তার হাতে থাকে সামান্য নগদ টাকা। আমি জানি না সরকার কেন এমন করছে।

“এছাড়াও, ‘নয়-ছয় সুদনীতি’ করাটাও ঠিক হয়নি। সিদ্ধান্তগুলো অর্থনীতির দিক থেকে ঠিক না। সরকার জনগণের উন্নয়নে যে চেষ্টা করছে সেটার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ না।”

‘নয়-ছয় সুদনীতি’র তো অনেক সুবিধার কথা বলা হচ্ছে।

“আমি জানি না, বাজার অর্থনীতিতে কীভাবে সুদের নির্দিষ্ট হার ঠিক করে দেওয়া হয়। সরকার ব্যাংকগুলোকে বলতে পারে তোমরা আমানত ও ঋণের সুদের মধ্যে ফারাক কমাও। সব ধরনের সঞ্চয়ে ছয় শতাংশ সুদের হার কেমন করে হয়?  ফিক্সড করে দেওয়া ঠিক না। এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।”

এর কোনো সুবিধা কী দেখছেন না?

“সরকার ভাবছে, ‘নয়-ছয়’ করলে লেন্ডিং রেটটা কমানো যেতে পারে। আমানতকারীরা আর কোথায়ই বা যাবে। তাদেরকে ব্যাংকে টাকা রাখতেই হবে। কিন্তু, সরকার বুঝছে না যে আমানতকারীদের টাকা এখন ব্যাংকে যাচ্ছে না। ব্যাংকের ওপর তাদের আস্থা নেই। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শেয়ারবাজারও ভালো না। শেষমেশ আমানতকারীরা কথিত ‘সেভিংস সোসাইটি’তে যাবে, প্রাইভেট স্কিমে যাবে এবং টাকা খোয়াবে।”

“মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখছে না। ব্যাংকগুলোর তারল্য কমে গেছে। যাও আছে তা সরকার ঋণ হিসেবে নিয়ে নিচ্ছে। ফলে বেসরকারি খাত সংকটে পড়বে।”

আপনি বলছেন মানুষ ব্যাংক বিমুখ হয়ে যেতে পারে?

“হ্যাঁ, সঞ্চয়ের হার যদি কমে যায়, তাহলে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা ব্যাংকে টাকা রাখবে না। সরকার শুধু ঋণ করে উন্নয়ন করলে ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে। আমি জানি না, এ বিষয়গুলো সবাই যাচাই করে দেখেছেন কী না। দেখেছেন হয়তো! আসলে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই।”

সরকার বলছে, এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করা যাবে।

“সবাইকে শেয়ারবাজারে ঠেলে দিবেন? শেয়ারবাজারের ওপর মানুষের আস্থা নেই। এখানে কোনো স্বচ্ছতা নেই। এফবিসিসিআইয়ের কার্যকারিতা নেই। দক্ষতাও অনেক কম। স্বল্প আয়ের বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারবাজারে কেন যাবেন? তারা চান সুরক্ষিত ফিক্সড ইনকাম। আমি মনে করি না এসব উদ্যোগে শেয়ারবাজারের কোনো লাভ হবে।”

“মাঝে-মাঝে হয়তো মার্কেট ট্রানজেকশন বাড়বে। তবে এটা শেয়ারবাজারের উন্নতির চিহ্ন না।”

আপনার মূল্যায়নে দেশের আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা কেমন?

“সরকারের ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্ট ঠিকভাবে হচ্ছে না। মনিটরিং পলিসি, ব্যাংকিং পলিসি... কোনোটাই খুব ভালোভাবে ম্যানেজ করা হচ্ছে না। এর মূল প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে কাজের সুযোগ বাড়ে না। সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে। যাদের স্বল্প আয় তাদের জীবনযাত্রার মানের ওপর চাপ পড়ছে।”

“দিন-দিন মানুষের জীবনযাত্রার মান যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে যে বাড়ছে তা মনে হয় না।”

ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আদালত বলছেন, ‘এই অবস্থায় আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না’।

“দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা সবাই জানেন। এসব সমস্যা সমাধানের কোনো বাস্তবসম্মত উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। সরকার ছাড়া-ছাড়াভাবে এডহক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে।”

তাহলে এধরনের ‘ছাড়া-ছাড়া ব্যবস্থা’ কেন নেওয়া হচ্ছে? বিশেষ করে ‘নয়-ছয় সুদনীতি’র বিষয়ে?

“কিছু চাপ আছে। বিশেষ করে, ঋণগ্রহীতারা চাচ্ছে। কিন্তু, সুদের হার তো ব্যবসার একমাত্র খরচ না। ব্যবসার জন্যে পরিবহণ, জ্বালানি খরচ আছে। বিভিন্নজনের দ্বারে দ্বারে যেতে হয়। সেগুলোর খরচ আছে। সরকারকে বলবো, সেসব খরচ একটু কমান। সুদের হার সব খরচের একটি খরচ মাত্র। ব্যবসায়ীরা শুধু সুদের হার কমানোর কথা বলছেন। অন্যসব বিষয়ে কিছু বলতে পারেন না। সাধারণ মানুষের টাকার ওপর তাদের দৃষ্টি।”

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘নয়-ছয় সুদনীতি’র ফলে মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, লাভবান হবেন গুটি কয়েক উচ্চবিত্ত মানুষ।

“শুধু মধ্যবিত্ত নন, নিম্নবিত্তরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। চাকরিজীবী, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষদের ক্ষতি হবে।”

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বললেন, “সুদের হার যদি মুদ্রাস্ফীতির হারের সমান হয়ে যায় তাহলে যে টাকা জমা থাকে তা কমে যায়। সেজন্যে সুদের হার আমাদের দেশে একটু বেশি। যেমন ধরুন, ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির হার থাকে ১ শতাংশের মতো। সেজন্যে সেখানে সুদের হার দুই বা আড়াই শতাংশ হতে পারে। আমাদের দেশে যখন ৬ শতাংশের মতো মুদ্রাস্ফীতি সেখানে আমানতের ওপর ৭/৮ শতাংশ সুদের হার হওয়া যৌক্তিক। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটাই স্বাভাবিক।”

“এখন যেটা হচ্ছে, সরকার জোর করে সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে বাজার অর্থনীতি ডিসটরটেড হবে। এমন চিত্র আস্তে আস্তে আমরা দেখতে পাবো। দিন শেষে, এটা খুব সুবিধাজনক হবে বলে মনে হয় না। অনেক জায়গায় অ্যাডজাসমেন্টের প্রয়োজন হবে। শেষে দেখা যাবে, পুরো বাজার ব্যবস্থাই ডিসটরটেড হয়ে গেছে।”

তাহলে যে ‘নয়-ছয় সুদনীতি’র কথা বলা হচ্ছে তা কার্যকর করা যাবে না?

“এখন জোর করে কার্যকর করা হচ্ছে। আমি বলতে চাচ্ছি, বাজার অর্থনীতিতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না। অর্থনীতিকে আঘাত করলে অর্থনীতিও পাল্টা আঘাত করবে। তখন পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টালমাটাল হয়ে যেতে পারে। আমরা প্রকৃতিকে আঘাত করতে করতে এমন অবস্থা গেছি যে এখন প্রকৃতি আমাদের আঘাত করছে। এমন পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতেও সৃষ্টি হতে পারে।”

এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে নিশ্চয় যুক্তি আছে?

“যারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন।”

সরকারের যুক্তি, এর ফলে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

“শেয়ারবাজারে সমস্যা হলো আস্থাহীনতা। ওখানে টাকার সমস্যা না। কারণ, যে দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ, সে দেশে টাকার অভাব হতে পারে না। অনেক মানুষের হাতে টাকা আছে। তারা শেয়ারবাজারে আসছেন না সেটা অন্য কারণ। সেই কারণটি খুঁজতে হবে। আমরা ভুল অ্যাসেসমেন্ট করছি।”

তাহলে দেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা কেমন?

“ঐ যে বললাম, দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে চালানো হচ্ছে তা গোলযোগ সৃষ্টি করবে।”

আদালত বলছেন, ‘এই অবস্থায় আমরা আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না’।

“স্বাভাবিক। তারা দেশের সচেতন নাগরিক। তাই এমন কথা বলেছেন। যারা নীতিনির্ধারণ করেন তারাও দেশের নাগরিক। কিন্তু, তারা নিজেদের বা গোষ্ঠী স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে মধ্যবিত্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, উচ্চবিত্ত লাভবান হবেন।

“মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সবারই ক্ষতি হবে। একমাত্র যারা উচ্চবিত্ত, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, তারা সুবিধা পাবেন। মানে, তেলা মাথায় তেল দেওয়া হবে। যাদের টাকা আছে তাদের টাকা আরও যেন বাড়ে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

উচ্চবিত্তরা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকেন বলেই কি তারা নিজেদের জন্যে সুবিধাজনক নিয়ম করেন?

“আমিতো বলবো, তারাই ক্ষমতায় আছেন। আমার মতে, রাজনৈতিক শক্তি এখন ক্ষমতায় নেই। রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে। ধনীরা রাজনীতি কিনে নিয়েছেন। এই পুরো ব্যবস্থা বদলানো না গেলে আমরা ভালো সিদ্ধান্ত পাবো বলে মনে হয় না।”

অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, “সুদের হার কমালে তো বিনিয়োগকারীদের সুবিধা হয়। আসল সমস্যাগুলোতে হাত না দিয়ে ‘সুদের হার নয়-ছয়’ করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাতে পারছে না। কারণ, ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ এতো বেশি যে তাদের ‘কসট অব ফান্ড’ বেশি পড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে অনেক বেশি প্রভিশন করতে হয়। খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে সরকার এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার ঋণখেলাপিদের নানা রকম সুবিধা দিচ্ছে।”

“খেলাপিরা আসলে ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে, তাদেরকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা দরকার এটা আমাদের নীতিপ্রণেতাদের বোঝানো যাচ্ছে না। কারণ, সরকারের কাছের কেউ কেউ সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি। বড় বড় খেলাপিরা তাদের ঋণ রিশিডিউল করে তা লুকিয়ে রেখেছে।”

“আসল সমস্যায় হাত না দিয়ে সরকার এখন যেভাবে ‘নয়-ছয়’র ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে তা সফল হবে বলে আমি মনে করি না। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। ট্রাইব্যুনাল করে সরকার যদি বড় বড় ঋণখেলাপিদের শাস্তি দিতে না পারে তাহলে এর সমাধান হবে না।”

‘নয়-ছয় সুদনীতি’ তাহলে কার্যকর হবে না বলে আপনি মনে করছেন?

“সরকার জোর করে কার্যকর করবে। এই নীতি সরকার হয়তো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে চালু করবে। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আরও সময় দেওয়া হচ্ছে। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গিও বৈষম্যমূলক। আগামী ১ এপ্রিল থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে বাধ্য করা হবে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পারবে কী না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।”

“আসল সমস্যায় তারা হাত দিচ্ছে না। ‘নয়-ছয়’র থেকে বড় সমস্যা হলো: যারা ঋণ নিচ্ছেন তাদেরকে সেই ঋণ ফেরত দিতে হবে এবং সেই টাকা উৎপাদনশীল খাতে খরচ করতে হবে। সেই পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। তা তৈরি করতে যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার তাও সরকার এখন পর্যন্ত নিচ্ছে না। আমি মনে করি, এখানেই সমস্যার মূল কারণ লুকিয়ে আছে।”

তাহলে এই সুদনীতির সুবিধা কারা পাবেন এবং অসুবিধায় কারা পড়বেন?

“যারা ঋণ নিবেন তারা সুবিধা পাবেন। অসুবিধায় পড়বেন যারা ব্যাংকে টাকা জমা রাখবেন। ঋণ নিয়ে টাকা পাচার করার পথ বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা আমি দেখছি না।”

“বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার খুব সহজ কাজ। রেমিট্যান্সের অধিকাংশ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে আসে। এই হুন্ডির মাধ্যমে তারা কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে পারে।”

দেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা কেমন?

“এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আর্থিকখাতের বড় সমস্যা হচ্ছে, ঋণের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। উৎপাদনশীল বিনিয়োগ হয়নি। এটিকে প্রতিরোধ করতে যা করা দরকার তা বর্তমান অর্থমন্ত্রী করবেন না। সমস্যার আরেকটি মূল কারণ হচ্ছে, যারা সমস্যাগুলো সৃষ্টি করেছে, তারাই নীতি নির্ধারক। তারা সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে যাচ্ছে না।”

“খেলাপিঋণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পুঁজি পাচার হচ্ছে। সেটিই বর্তমান অর্থনৈতিক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা। যারা ঋণখেলাপি তারা ভুঁইফোড় খেলাপি। তারা ইচ্ছে করে খেলাপি হচ্ছে। কারণ তারা জানে, তাদের থেকে সরকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারবে না। তাদের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে থাকে। তারাও বিদেশে যাওয়া-আসা করেন। যদি এখানে ধরপাকড় শুরু হয় তাহলে তারা বিদেশে পালিয়ে চলে যাবে। কেননা, তাদের পুঁজি ইতোমধ্যে বিদেশে চলে গেছে।”

“খেলাপিঋণের মামলা উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর আটকে আছে। বিচারাধীন থাকার ফলে সেগুলোকে আর খেলাপিঋণ বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে খেলাপিঋণ তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব দিচ্ছে খেলাপিঋণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এটা একটা ভুয়া হিসাব।”

সরকার বলছে, ‘নয়-ছয় সুদনীতি’র ফলে শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবে।

“ব্যাংকের সুদের হার যেহেতু ছয় শতাংশের নিচে নেমে যাচ্ছে তাই কিছু মানুষের বিকল্প হিসেবে শেয়ারবাজারে টাকা বিনিয়োগ করার প্রবণতা বাড়তে পারে। সঞ্চয়কারীদের কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু, তারা আবার ধরা খাবেন। উপদেষ্টারা সিন্ডিকেট করে শেয়ারবাজার থেকে আবার টাকা লুটে নিবে।”

“শেয়ারবাজারে এখনো স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। শেয়ারবাজারের ওপর মানুষের আস্থা এতো সহজে ফেরানো যাবে বলে মনে হয় না।”

তাহলে কি মানুষ সঞ্চয় বিমুখ হয়ে যেতে পারে?

“মানুষ যে শুধু সুদের আশায় সঞ্চয় করেন তা নয়। এখনো ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন তারা নিরাপত্তার জন্যেই টাকা রাখেন। প্রবাসীরা যে টাকা পাঠান তা ব্যাংকের আমানতের একটা বড় অংশ। প্রবাসীদের টাকা ঘরে রাখা হলে সেই ঘরে ডাকাত ঢুকবে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের টাকার কারণে ব্যাংকে আমানতের সঙ্কট হচ্ছে না।”

এই সুদনীতির ফলে আসলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?

“মূল ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অবসরে যাওয়া বা স্বল্প আয়ের মানুষজন। যারা সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে সংসার চালাতেন। এখন তাদের আয়টা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।”

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘নয়-ছয় করা’। এটা কি দেশের অর্থনীতির ওপর বর্তাচ্ছে?

“এখানে সেই অর্থে ‘নয়-ছয়’ বলা যাবে না। এই সুদনীতির একটি ইতিবাচক দিক হলো আমানতের সুদের হার এবং ঋণের সুদের হারের মধ্যে যে ৪-৫ শতাংশ পার্থক্য আছে তা খুবই বেশি। এখন যদি সরকার ‘নয় ছয়’র মাধ্যমে তা তিন শতাংশে নামাতে পারে তাহলে তা হবে ইতিবাচক দিক।”

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago