সীমান্তের মানুষ সীমান্তের জীবন

বাংলাবান্ধা, সোনামসজিদ ও বুড়িমারী। বাংলাদেশ ও ভারতের তিনটি সীমান্ত এলাকা। কেমন দৃশ্য ভাসছে আপনার চোখের সামনে? মাইলের পর মাইল কাঁটাতারের বেড়া? মানচিত্রের মতো স্পষ্টভাবে দেওয়া কিছু সীমারেখা?
ভারতে দাঁড়িয়ে তোলা বাংলাদেশের ছবি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনা মসজিদ জিরো পয়েন্ট। দোকানের পাশের বোর্ডে বাংলা ও হিন্দিতে লেখা। দুই দেশের মানুষই এই দোকানের ক্রেতা। ছবি: জায়মা ইসলাম

বাংলাবান্ধা, সোনামসজিদ ও বুড়িমারী। বাংলাদেশ ও ভারতের তিনটি সীমান্ত এলাকা।

কেমন দৃশ্য ভাসছে আপনার চোখের সামনে? মাইলের পর মাইল কাঁটাতারের বেড়া? মানচিত্রের মতো স্পষ্টভাবে দেওয়া কিছু সীমারেখা? 

অধিকাংশ মানুষের কাছেই সীমান্ত পেরিয়ে পাশের দেশে যাওয়া মানেই পাসপোর্ট-ভিসার মতো কিছু আনুষ্ঠানিকতা। যাওয়ার বেশ আগেই সেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নিতে হয়। 

কিন্তু, সীমান্তে যারা বসবাস করেন, তাদের কাছে বিষয়টি ভিন্ন রকমের। তাদের অনেকের কাছে সীমান্ত অদৃশ্য। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই তারা আসা-যাওয়া করেন এপার-ওপার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-মালদা সীমান্তের কথাই ধরুন। বাংলাদেশের সীমানায় ভারতীয়দের ও ভারতীয় সীমানায় বাংলাদেশিদের দেখা মিলবে। তারা এই সীমান্তের চাষের জমিতে কাজ করার জন্য প্রতিটি দিন ‘সীমানা অতিক্রম’ করেন। তবে তাদের জন্য ‘সীমানা অতিক্রম’ শব্দটি সম্ভবত ঠিক প্রযোজ্য না। কারণ, কৃষিকাজের জন্যে তারা শুধুমাত্র তাদের জমিতে যান।

নামোচাকপাড়ার সীমান্তে দেখা হলো হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। ৭০ থেকে ৭৫ বছর বয়স হবে তার। তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক। তার পাশে কাজ করছেন মামুন ও মামুনের ভাই। দুজনেই বাংলাদেশি। তাদের জমি এখনও ভারতের মিলিক সুলতানপুর গ্রামে। এখানকার সীমান্তটি বাংলাদেশ ও ভারতকে আলাদা করেছে এই জমির মাঝখান দিয়ে আড়াআড়িভাবে।

একটা কলাগাছের নিচে থাকা ছোট পিরামিড আকৃতির সীমানা চিহ্ন দেখিয়ে হাবিবুর রহমান বলছিলেন, “এখান থেকেই ভারত শুরু।” তার মাঠে পৌঁছাতে হলে এর পাশ দিয়েই হেঁটে ভারতের ভূখণ্ডে যেতে হবে।

তিনি বলেন, “আমার বাড়ি মিলিক সুলতানপুরে। এই জমিটি আমার পৈতৃক সম্পত্তি। নামোচাকপাড়া থেকে আমি দুজন বর্গাচাষি নিয়েছি। কারণ, আমার জমি ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে বেশি কাছে।” মামুন ও তার ভাই হাবিবুরের সঙ্গে দুবছর ধরে কাজ করছেন। সবসময়ই হাবিবুর বাংলাদেশিদের বর্গাচাষি হিসেবে বেছে নেন।

হাবিবুর রহমান বলেন, “প্রতিদিন আমি আমার জমিতে আসার আগে বিএসএফের কাছে আমার আধার কার্ড (জাতীয় পরিচয় পত্র) জমা দিয়ে আসি। বিকেল চারটায় ক্যাম্প বন্ধ হওয়ার আগে আমাকে কার্ড সংগ্রহ করতে ফিরে যেতে হয়।”

মামুন ও তার ভাইয়ের সীমান্ত পার হতে হাবিবুরের মতো বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে হয় না। মামুন বলেন, “আমরা জমির যত্ন নেই। চাষ করি, রাতে পাহারা দেই, যাতে ফসল চুরি না হয়।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের তারাপুরে দুই দেশের সীমান্তের মাঝে নদী। যা আমাদের কাছে পদ্মা ও ভারতীয়দের কাছে গঙ্গা। অনেকটা অঘোষিত সীমান্ত হিসেবে কাজ করে এই নদী। বর্ষায় নদীতে স্পিড বোর্ড ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে টহল দেয় বিজিবি এবং বিএসএফ। 

নদীতে বেশকিছু বড় নৌকা চলছে। তবে সীমান্তের বাসিন্দারা ইচ্ছে করলেই নদী পার হতে পারেন না। নৌকাগুলো যাত্রী পারাপারের কাজে ব্যবহৃত হয় না। অভিযোগ আছে, নৌকাগুলো চোরাচালানের কাজে ব্যবহৃত হয়। তারাপুরের বাসিন্দাদের প্রায় সবাই গবাদি পশু লালন-পালন করেন ও চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা যায়।

এখানকার বাসিন্দা সৈকত (ছদ্মনাম) ভারত থেকে বাংলাদেশে চোরাচালানের মাধ্যমে গরু আনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই নৌকাগুলোতেই গরু আনা হয়।  তবে সৈকত বিষয়টি চোরাচালান হিসেবে দেখেন না। তিনি বলেন, “ভারতে গরুর দরকার নেই, কিন্তু আমাদের আছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা এই পথ দিয়েই গরু নিয়ে আসতেন। গরু চরানোর জন্য আম বাগানের ভেতরে আমাদের প্রচুর খালি জমি আছে। এখানে গরু লালন-পালন করার খরচ কম। সবাই এটাই করছে।”

সৈকতের কথায় বোঝা যায়, সীমান্ত-চোরাচালান, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কর আইনের ধারণা থেকে তারা অনেক দূরে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার নমোচাকপাড়ার পাশের ভারতীয় ভূখণ্ডে একটি জমিতে কাজ করছেন বাংলাদেশি একজন বর্গা চাষি। জমির মালিক ভারতীয় হলেও তিনি বাংলাদেশি চাষিদের দিয়ে কাজ করান। কারণ নিকটস্থ ভারতীয় গ্রাম মিলিক সুলতানপুর এই জমিটা থেকে অনেক দূরে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: জায়মা ইসলাম

নদীর পাড়েই একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তিনি নদীর অপর পাড়ে ভারতে তার শ্যালিকার বাড়ি দেখালেন। তিনি বলছিলেন, “ওই যে টাওয়ারটা, দেখা যায়? ওখানেই থাকে তারা। আগে আমরা নিয়মিত তাকে দেখতে নদী পার হয়ে যেতাম। কিন্তু, ১০ বছর আগে সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে এখন ওখানে যেতে আমাদের ইমিগ্রেশন অফিসের মাধ্যমে অনেক রাস্তা ঘুরে যেতে হয়। তাই আর আগের মতো যাওয়া হয় না।”

আমার নানা ভারতের নাগরিক ছিলেন। নানা বহুবার নদী পার হয়েছেন। তিনি গোদাগাড়ী-লালগোলা সীমান্ত দিয়ে পদ্মা নদী পার হতেন। সেখানে নদী সবচেয়ে সরু, দুপাশ ঘেঁষে চর। নানা আমার নানিকে বিয়ে করার জন্যে নদী পার হয়ে এপারে এসেছিলেন। নানির বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জ। পরবর্তীতে সীমান্ত পারাপারের নিয়মে কড়াকড়ি হয়। পার হতে হলে পাসপোর্ট, ভিসা লাগে। শয্যাশায়ী নানি আফসোস করে বলেন, মনে হয় মারা যাওয়ার আগে শেষবারের মতো আমার শ্বশুরবাড়ি দেখতে পারবো না।

আমার মামাও এভাবেই বিয়ে করেছিলেন। তিনি মামিকে বিয়ে করার জন্য নদী পার হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। তীব্র রোদের মধ্যে চর দিয়ে হেঁটে বাংলাদেশে ফেরার সময় আমার সদ্য বিবাহিত মামি মূর্ছা গিয়েছিলেন। কয়েক বছর পরে ১৯৯০ সালে, আমার মা-ও নদীর ওপারে গিয়েছিলেন। তবে তিনি বিয়ে করতে যাননি। গিয়েছিলেন তার বিয়ের বেনারসি কেনার জন্য।

নদী যেমন আমার মাকে তার স্বপ্নের শাড়ি থেকে দূরে রাখতে পারেনি, তেমনি নিয়মনীতির বেড়াজালও সোনামসজিদের বর ও কনেদের মালদার বিয়ের বাজার থেকে দূরে রাখতে পারে না। যদি কেউ মালদা থেকে কেনাকাটা করে দিতে পারে, তাহলে তা এদেশে নিয়ে আসা কোনো সমস্যা না। এমন একদল মানুষ আছে যারা ভিসা নিয়ে সবসময় প্রস্তুত থাকে। তারা মালদা গিয়ে আপনার মালামাল এনে দেবে।

সোনামসজিদ স্থলবন্দরের বাইরে উদ্বিগ্নভাবে পায়চারি করছিলেন বায়রুল। তিনি বলেন, “আমার ভাতিজা বিয়ে করছে। আমরা মালদাতে থাকা আমাদের আত্মীয়দের কেনাকাটা করতে দিয়েছিলাম। আজ একজনকে পাঠিয়েছি যে ওপার থেকে জিনিসগুলো নিয়ে আসবে। এক ঘণ্টার মধ্যে তার ফিরে আসার কথা।”

রাজশাহী বিভাগীয় শহরে না গিয়ে কেনাকাটার জন্য মালদাকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “চাঁপাইয়ের মানুষদের কাছে মালদাই কাছে এবং সেখানকার জিনিসও ভালো। বিশেষ করে মেয়েদের প্রয়োজনীয় প্রসাধনী।”

বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারতীয়দের মিলনমেলার জন্য জিরো পয়েন্টে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমা টানা হয়েছে। মাঝে কয়েক ফুট ফাঁকা, দুই দেশে দুটি বাঁশের বেড়া। ফাঁকা স্থানে সীমান্তরক্ষীদের উপস্থিতিতে দুদেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে নিজেদের আত্মীয়দের দেখা যায়, কথা বলা যায়।  কিন্তু স্পর্শ করা যায় না!

আরিফ হোসেন তার চাচার সঙ্গে কথা বলছিলেন। এত মানুষের ভিড়ে তাকে বেশ চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছিল, “কেমন চলছে সব?” তার চাচাও অপর পাশ থেকে উত্তর দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে তাদের কথা ফুরিয়ে যায়। তারা একে অপরের দিকে শুধুই তাকিয়ে রইলেন বাকহীন দৃষ্টিতে। আরিফের কাছে জানতে চাইলাম, তার চাচা বাংলাদেশে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেন কিনা?

তিনি বললেন, “না, তিনি বহু বছর আগেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু, কাগজপত্রের অভাবে পাসপোর্ট পাননি এখনও। হয়তো শিগগিরই পেয়ে যাবেন।” আরিফের কথায় বোঝা গেল, তার চাচা ভারতে অনিবন্ধিত নাগরিক।

আরিফের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুল লাল শার্ট পড়া এক কুলির কাছে এক হাজার টাকা দেন অপর পাশের উজ্জ্বল কমলা রঙের শাড়ি পড়া নারীর হাতে দিতে। এই কুলিরা দুই সীমান্তে আসা মানুষের ব্যাগ বহন করতে সহায়তা করেন। শুধুমাত্র তারাই ভিসা ছাড়া এভাবে সীমান্ত পার হতে পারেন। বাবুল জানায়, “ও আমার চাচাতো বোন। ভারত থেকে কিছু ওষুধ পাঠানোর জন্য তার সহযোগিতা নিচ্ছি। এভাবে ছাড়া বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর আর তো উপায় নাই।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ-মাহদীপুর সীমান্ত। ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছনোর বেশ কয়েকশ গজ আগে সীমান্তটি ‘এন-৬’ মহাসড়কটির একেবারে পাশ ঘেঁষে চলে গেছে। এত কাছে যে, যদি কোনো গাড়ি ‘এন-৬’ মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ে, তাহলে তা ভারতের সীমানায় গিয়ে পড়বে। একটি পরিত্যক্ত বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) চেকপোস্ট সবাইকে যেন জানানোর চেষ্টা করছে যে, তারা ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও যাত্রীরা একসঙ্গে ভারতীয় ভূখণ্ডে একটা বড় আমের গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বা বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

এখানেই বিসমিল্লাহ ভাতের হোটেল। হোটেলটি বাংলাদেশে শুরু হয়ে ভারতে শেষ হয়েছে। হোটেলটিতে ক্লান্ত ভ্রমণকারীদের জন্য স্থানীয় হরেক পদের রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হয়। এই খাবারগুলো রান্না হয় তাদের ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা রান্নাঘরে। ডালপুরি বানাতে বানাতে হোটেলের একজন বাবুর্চি বলেন, “আমাদের রান্নাঘর ও টয়লেট ভারতে।”

সেখানে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের দেখা পাই। দুই পা ছড়িয়ে সীমান্তে বসে আছেন তিনি। ভারতীয় গাছের ছায়ায় বসে দিন কাটিয়ে তিনি খাওয়ার জন্য আসেন বাংলাদেশের বিসমিল্লাহ হোটেলে। তিনি কাউকেই তার নাম বলেন না, এমনকি তিনি বাংলাদেশি নাকি ভারতীয়, তাও কাউকে বলেন না। তার সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তা হলো, দুবছর আগে একদিন তিনি এখানে এসেছিলেন।

ঘটনাটি অনেকটা সাদাত হোসেন মান্টোর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘তোবা টেক সিং’র সঙ্গে মিলে যায়। গল্পটি দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তানের বন্দি বিনিময়ের ঘটনা নিয়ে লেখা। শিখ বাসিন্দাদের ভারতে ও মুসলমানদের পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল।

সেখানকার একজন শিখ বুঝতে পারছিলেন না, কী ঘটেছে এবং তিনি কেন পাকিস্তানি নন। তিনি তার জন্মভূমি থেকে, তার গ্রাম থেকে চলে যেতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান নো-ম্যানস ল্যান্ডে।

গল্পটির শেষে বলা হয়েছে, “ওদিকে কাঁটাতারের পেছনে হিন্দুস্তান। এদিকেও একই ধরনের কাঁটাতারের পেছনে পাকিস্তান। এই দুয়ের মধ্যে থাকা এই মাটির কোনো নাম নেই। এইখানেই তার জন্মভূমি তোবা টেক সিং।”

ঠিক তেমনই এই মানুষটি। নাম, নাগরিকত্ব ও সম্ভবত রাষ্ট্র ধারণার ধার ধারেন না তিনি। বাস করেন ঠিক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। তিনি যা বোঝেন ও যা বোঝা দরকার তা হলো, বাংলাদেশ তাকে খাদ্য দেয়, ভারত তাকে আশ্রয় দেয়। এভাবেই তিনি বেঁচে আছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago