বিআরটিসির গলার কাঁটা ১৬ বছর আগের এক চুক্তি

বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধায় আন্তঃজেলা রুটে নতুন বাস বিশেষ করে দোতলা বাস নামাতে পারছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন। বিআরটিসি নতুন বাস নামালে তাদের আয় কমে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন।
BRTC-Bus
স্টার ফাইল ছবি

বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধায় আন্তঃজেলা রুটে নতুন বাস বিশেষ করে দোতলা বাস নামাতে পারছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন। বিআরটিসি নতুন বাস নামালে তাদের আয় কমে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন।

ভাড়া তুলনামূলক কম হওয়ায়, আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসি বাসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তারপরও বেসরকারি পরিবহন মালিকদের চাপে নতুন রুটে বাস সার্ভিস চালু করতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়ছে সরকারি পরিববহন সংস্থাটি।

সূত্র জানায়, ১৬ বছর আগের এক চুক্তির সুযোগ নিয়ে পরিবহন মালিকরা বিআরটিসিকে বারবার চাপে ফেলছেন। সংস্থাটিকে চাপে ফেলতে ব্যবহার করা হচ্ছে শ্রমিকদের। ২০০৩ সালে তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মধ্যে চুক্তি হয়— আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসি দোতলা বাস নামাবে না।

যদিও দেশের যে কোনো জায়গায় বাস চালুর এখতিয়ার আছে সড়ক পরিবহন করপোরেশনের। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিআরটিসি’র এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “যখনই বিআরটিসি নতুন বাস নামানোর উদ্যোগ নেয়, বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তাতে বাধ সাধেন। বিআরটিসি’র নতুন ৬শ বাস রয়েছে। আরও বেশ কিছু রুট চালুর পরিকল্পনা নেওয়ায় এই সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।”

গত বছর জুনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করপোরেশনের করা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) বেসরকারি পরিবহন মালিকদের ‘অযাচিত বাধা’কে একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করা হয়।

চালু হচ্ছে না নতুন রুট

বিআরটিসি’র ৬শ নতুন বাসসহ মোট বাসের সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৩টি। এর মধ্যে ৩৮৪টি রুটে চলছে ১ হাজার ৩৫৭টি বাস। ২৫৯টি একেবারেই চলাচলের অনুপযোগী এবং ২২৪টি বাস নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। তবে সেগুলো মেরামত করে রাস্তায় নামানো সম্ভব। এ ছাড়া, প্রয়োজনীয় নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হলে ৩৩টি নতুন বাস রাস্তায় নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

সংস্থাটির সেবা বাড়াতে সরকার ভারতীয় নির্মাতাদের কাছ থেকে ৬শ বাস ও ৫শ ট্রাক কেনে। দুটি চুক্তির আওতায় প্রায় ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা যানবাহনগুলো গত বছর বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে পৌঁছে।

এর মধ্যে রয়েছে ৩শ ডাবল ডেকার, ১শ নন-এসি বাস, ১শ সিটি বাস (এসি), ১শ আন্তঃনগর বাস (এসি), ৩৫০টি ১৬.২ টন ওজন পরিবহনের সক্ষম ট্রাক এবং ১৫০টি ১০.২ টনি ট্রাক।

পরিকল্পনামাফিক বিআরটিসি নতুন রুটগুলোতে বাস চালুর উদ্যোগ নিলে নেত্রকোনা, দিনাজপুর, বগুড়া, বরিশাল, সুনামগঞ্জ ও রংপুরে স্থানীয় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা তাতে বাধা দেন। শেষ ঘটনাটি ঘটে রংপুরে। গত ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় পরিবহন শ্রমিকদের আপত্তির মুখে রংপুর শহর এবং এর আশেপাশের এলাকায় বিআরটিসি দোতলা বাস চলাচল স্থগিত করে দেওয়া হয়। এতে অসংখ্য যাত্রী ভোগান্তিতে পড়ে।

জাতীয় সংসদের স্পিকার ও রংপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন শারমিন চৌধুরী গত বছরের মে মাসে রংপুরে দোতলা বাস সার্ভিসের উদ্বোধন করেছিলেন। আটটি দোতলা বাস চালুর পর থেকেই বারবার বাধার মুখে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রংপুর বাস মালিক সমিতির সদস্য-সচিব একেএম আজিজুল ইসলাম রাজু বলেন, “আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় মহানগরীর বাইরের শ্রমিকরা বাস চলাচলে আপত্তি জানাচ্ছেন।”

গত বছর ডিসেম্বরে বিআরটিসি ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা রুটে পাঁচটি দোতলা বাস সার্ভিস চালু করলে একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। দুই জেলাতেই ধর্মঘট ডাকেন বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।

ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলায় বিআরটিসি’র একতলা বাস চলতেও বাধা দেন তারা। শেষ পর্যন্ত আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসি দোতলা বাস চলাচল স্থগিত করা হয়।

বিআরটিসির ময়মনসিংহ ডিপো ম্যানেজার লুৎফর আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমরা ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা রুটে পাঁচটি দোতলা বাস চালানো শুরু করেছিলাম। কিন্তু এখন এক ধরনের আলাপ-আলোচনার পর আমরা এই রুটে দোতলা বাস সার্ভিস বন্ধ করে তিনটি একতলা বাস চালাচ্ছি। তবে ময়মনসিংহের ভেতরে দোতলা বাস সার্ভিস চালু আছে।” 

মালিক-শ্রমিকদের আপত্তি

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, “২০০৩ সালের চুক্তি কার্যকর থাকায় স্থানীয় পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা বিআরটিসি’র উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। তা ছাড়া মহাসড়কে নসিমন, করিমনের মতো অবৈধ যানবাহন চলায় বেসরকারি পরিবহন শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। নতুন করে আবার বিআরটিসি বাস নামায় তারা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে এ কাজ করছেন। তবে আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।”

চুক্তি অনুযায়ী, ডিপোর পরিবর্তে বিআরটিসি টার্মিনাল থেকে বাস পরিচালনা করতে চাইলে ট্রিপ সংখ্যা ও চলাচলের সময় নির্ধারণে স্থানীয় বেসরকারি পরিবহন সংস্থার সঙ্গে আলাপ করতে হবে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বিআরটিসি তা মানে না বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় মালিক ও শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী অভিযোগ করে বলেন, “অনির্ধারিত স্থান থেকে বাস পরিচালনার মাধ্যমে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ এই চুক্তি লঙ্ঘন করছে। এ কারণে স্থানীয় শ্রমিক ও মালিকরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।”

ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় মোট ২১টি বাস ডিপো এবং দুটি ট্রাক ডিপো আছে বিআরটিসির। অন্য একটি নির্দেশনা আছে, ঢাকা থেকে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল রুটে বিআরটিসির বাস কল্যাণপুর ডিপো থেকে পরিচালিত হবে। পূর্বাঞ্চলে মতিঝিল ডিপো থেকে বাস সার্ভিস পরিচালিত হবে।

শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি

২০০৩ সালের ২০ আগস্ট তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফেডারেশনের সভাপতি ওয়াজি উদ্দিন খান এবং কার্যনির্বাহী সভাপতি, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য শাজাহান খান সংস্থাটির পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন।

চুক্তির ৮(খ) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, “আন্তঃজেলা রুটে চলমান বিআরটিসির দোতলা বাস সার্ভিস আজ থেকে বন্ধ হবে।”

চুক্তি অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে তত্কালীন বিআরটিসির চেয়ারম্যান পাঁচটি নির্দেশনা জারি করেন। এর মধ্যে আন্তঃজেলা রুটে দোতলা বাস সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টিও ছিল। তাতে বলা হয়েছিল, “আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি এবং স্থানীয় (পরিবহন) মালিক সমিতিকে জানিয়ে বিআরটিসির বাস চলাচলের সময় ও সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।”

বিআরটিসি’র এক কর্মকর্তা জানান যে তারা যখনই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে যান, পরিবহন মালিকেরা ট্রিপের সংখ্যা কমিয়ে অফ-পিক সময়ে বাস চলাচলের প্রস্তাব দেন। এতে বিআরটিসি সেবা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান এহসান-ই-এলাহী বলেন, “দোতলা বাসের ক্ষেত্রেই বেশি বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়। চুক্তিটি তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী স্বাক্ষরিত হওয়ায় আমরা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছি।”

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এত বছর আগের সেই চুক্তির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “বিআরটিসির চেয়ারম্যানকে পরিবহন নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা বলেছি।”

বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন শীর্ষ পরিবহন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।”

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

18m ago