শেষ হোক এই সংলাপ ‘তুমি সারাদিন করোটা কী’

আমি তখন স্কুলে পড়ি। আম্মা সপ্তাহখানেকের জন্য রংপুর গেল। আম্মা যাওয়ার পরপরই বাসায় চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনা দেখা দিলো। সহযোগী থাকার পরও খাবার-দাবারের মানের যা তা অবস্থা, আব্বার কোনো কাজ ঠিক মতো হচ্ছে না, আমাদের স্কুলের কাপড়-চোপড় অবিন্যস্ত হয়ে আছে, ঠিক সময়ে নাস্তা টেবিলে আসছে না, তরকারিতে লবণ বেশি কিংবা কম হচ্ছে। সে এক দুঃসহ অবস্থা। শেষে আব্বা ফোন করে আম্মাকে চার দিনের মাথায় ঢাকায় ফিরিয়ে আনলো।
Household-work
ছবি: সংগৃহীত

আমি তখন স্কুলে পড়ি। আম্মা সপ্তাহখানেকের জন্য রংপুর গেল। আম্মা যাওয়ার পরপরই বাসায় চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনা দেখা দিলো। সহযোগী থাকার পরও খাবার-দাবারের মানের যা তা অবস্থা, আব্বার কোনো কাজ ঠিক মতো হচ্ছে না, আমাদের স্কুলের কাপড়-চোপড় অবিন্যস্ত হয়ে আছে, ঠিক সময়ে নাস্তা টেবিলে আসছে না, তরকারিতে লবণ বেশি কিংবা কম হচ্ছে। সে এক দুঃসহ অবস্থা। শেষে আব্বা ফোন করে আম্মাকে চার দিনের মাথায় ঢাকায় ফিরিয়ে আনলো।

আমরাও হাড়ে-হাড়ে বুঝলাম যতই বকাবকি করুক আর পড়াশোনার জন্য হইচই করুক, আম্মা ছাড়া আমরা অসহায়। সে ছাড়া আমাদের সংসার শূন্য। তার সেবা ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া আমাদের কোনো কিছুই হয় না। সেবার থেকেই মেনে নিলাম আম্মাই হলো বাসার প্রকৃত বস। এ কথা এখনো মানি যে আম্মার তত্ত্বাবধান ছাড়া আমাদের কারো পড়াশোনা হতো না। অসুস্থতার সময় আম্মা ছাড়া আমাদের সেবা করার আর কেউ থাকতো না। আব্বা থাকলেও আম্মাই ছিল আসল। সেদিন বুঝিনি আম্মার এই গৃহস্থালি কাজের এবং সেবামূলক কাজের পরিমাপ কতটা বা এই কাজ জিডিপিতে কতটা প্রভাব রাখতে পারে। স্কুল থেকে বাসায় ঢুকে চিৎকার করে বলতাম— আম্মা ক্ষুধা লেগেছে, খাবার দাও। তারপর খেয়ে-দেয়ে আম্মার আঁচলে মুখ মুছে চলে যেতাম।

আজ বুঝতে পারি সংসারে মায়ের কাজের যে ভার, তা আর কারো কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম না, বরং বেশি। আমি বা আমরা এ কথা বুঝলেও এই সমাজ বা রাষ্ট্র কতটা বোঝে? সেদিন একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাদের সবাই নারী। কাউকে আমি চিনি, কাউকে চিনি না। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে কথা উঠল কে কী কাজ করে সে প্রসঙ্গে। সবাই সবার পেশার কথা বলছেন। কেউ ডাক্তার, কেউবা শিক্ষক, কেউ ব্যাংকার। একজন বললেন, আমি কিছু করি না এবং আরেকজন বললেন, আমি শুধু সংসার করি। লক্ষ্য করলাম, নিজেদের পরিচয় দেওয়ার সময় শেষের দুজনের মাথা নত হয়ে এলো। তাদেরকে দেখে মনে হলো তারা যেন তাদের পরিচয় নিয়ে লজ্জিত।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আমি তাদের উদ্দেশে বললাম, কে বলেছে আপনারা কিছু করেন না! সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি আপনারা যা করেন, কখনো কি সেই কাজের হিসাব করে দেখেছেন? সেই কাজটা আপনি না করে অন্য কাউকে দিয়ে করালে এই খাতে পরিবারের কী পরিমাণ অর্থ খরচ হতো একবার চিন্তা করুন। শুধু কী খরচ! কত ধরনের ঝামেলা পোহাতে হতো পরিবারের সদস্যকে। আপনি বাড়িতে আছেন বলেই আপনার স্বামী-সন্তান যথা সময়ে যথাযথ সুবিধা পাচ্ছে। তাদের রোগে-শোকে আপনিই পাশে থাকেন। সংসারের সব কাজ করেন, বয়স্ক মানুষ থাকলে তাদের দেখাশোনা করেন। সন্তানকে পড়ান, টিফিন তৈরি করে দেন, স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজটি করেন। আরও সব সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেন। তাহলে আপনি কাজ করেন না— এ কথা কি ধোপে টেকে? টেকে না। আমার যুক্তি শুনে তিনি খুশি হলেন ঠিকই, কিন্তু শান্তি পেলেন না।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খাতে অনেক কিছু অর্জন করেছে। বাংলাদেশের শ্রম বাজারে গত ২ থেকে ৩ দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। ৮০ সালের মাঝামাঝিতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৬-১৭ বছরে এসে তা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার পরও এই সংখ্যাগত হার তেমন বাড়েনি। এখনো পুরুষের তুলনায় অনেক কম।

এর পাশাপাশি অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখনো যথার্থ দৃষ্টি পাচ্ছে না। নারী তার সময়ের একটা বড় অংশ বাজার কেন্দ্রিক কাজের চেয়ে বাজার বহির্ভূত কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। গৃহস্থালি এই কাজগুলোকে অর্থনৈতিক মূল্যহীন কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অস্বীকৃত এবং অদৃশ্য কাজগুলো শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, শিশুরযত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্ন নয়। এর সঙ্গে আছে কৃষিকাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা ও বীজ সংরক্ষণ।

অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন ২০১৫ সালে দেখিয়েছেন নারীর এই অমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজ বাংলাদেশের জিডিপি’র ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমান (২০১৩-১৪ অর্থবছর)। অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, দেশে ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। পুরুষের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে (এসএনএ) যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ।

যেহেতু আর্থিক মূল্য না থাকলে কোনো কাজই বাজারঅর্থনীতির অর্ন্তভুক্ত হয় না, তাই বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিবিদরা সাধারণত স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করেন। স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে নারীর অমূল্যায়িত কাজকে চিহ্নিত করেন। জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি বা সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টসের (এসএনএ) মাধ্যমে কঠিন সীমাবদ্ধ চৌহদ্দি অতিক্রম করা যেতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি হিসাব পদ্ধতি, যা দিয়ে ঘরের অর্থনৈতিক মূল্যহীন সেবামূলক বা গৃহস্থালি কাজ মাপা হয়। কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা না রেখেই নারীরা গৃহস্থালি কাজ করে থাকেন। তাদের কাজগুলো উৎপাদনের জাতীয় হিসাব অথবা জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতির (এসএনএ) বাইরে থাকে। যদিও জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

যে কোনো নীতি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিবারে নারীর সার্বিক দায়িত্বের বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে। তাতে জিডিপিতে নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন করা সহজ হবে। এখন বৈশ্বিক এজেন্ডা হচ্ছে, এমন সমাধান খুঁজে বের করা যার মাধ্যমে নীতি বা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারীর অর্থনৈতিক কাজকে উৎসাহিত করা যায়। সেই সঙ্গে এমন সুযোগ সৃষ্টি করা যেন নারী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।

পরিবারে নারীর অস্বীকৃত কাজের মূল্যায়ন করে তা জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ২০১২ সাল থেকে দেশব্যাপী ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ শীর্ষক প্রচারাভিযান চালিয়ে আসছে। সরকার, দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যেন এমন পলিসি ডিজাইন করতে পারে যাতে সেবা দাতা ও সেবা গ্রহীতাকে সহায়তা বা সমর্থন দেওয়া যায়। সেই লক্ষ্যে সংস্থাটি কাজ করে যাচ্ছে।

জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে এসডিজি ৫ অর্জন করতে হলে অবশ্যই নারীর এই অস্বীকৃত গৃহস্থালির কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিশ্বাস করে যে পরিবার ও সমাজে  নারীর সব কাজের মূল্যায়ন হলে নারীর মর্যাদা বাড়বে এবং নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার পরিমাণ কমে আসবে। এর ভালো উদাহরণ হলো— নেপাল, মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং কেনিয়াসহ আরও ৮টি দেশ।

সংস্থাটি জেন্ডার লেন্স দিয়ে ৬টি মন্ত্রণালয়ের বাজেট পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছে (জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০১৯)। তাদের সুপারিশ হলো, নারীবান্ধব অবকাঠামোগত বরাদ্দ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা, জনসেবা ও গৃহস্থালি কাজ বা দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার।

দেশে ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ নারী এবং শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজে যুক্ত। সরকারিভাবে  মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীরা যে গৃহস্থালি কাজ করেন, সেটা এসএনএ-তে যোগ করলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কোনো দেশ যদি অধিকতর বাস্তবসম্মত শ্রম এবং কর্মসংস্থান নীতি গ্রহণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই নারীর গৃহস্থালি কাজকে শ্রমবাজার অর্থনীতির আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। নারীর শ্রমকে তুলে ধরতে সরকারের উচিত তাদের কর্মঘণ্টা জরিপের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া। সেই সঙ্গে তাদের সেবাদানকারী ভূমিকাকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দেওয়া।

নারীর কর্মঘণ্টার হিসাব দিয়ে একটি নিয়মিত ও সমন্বিত তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা যেতে পারে। এই কাজে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। মোট কথা অমূল্যায়িত সেবাকে জেন্ডার রেসপনসিভ বাজেটিংয়ের সঙ্গে একীভূত করতে হবে। সরকার, এনজিও, করপোরেট, বাণিজ্যিক ও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি একটি সংলাপ অনুষ্ঠানে বলেছেন যে এবারের বাজেটে তিনি নারীর গৃহস্থালি কাজকে জিডিপি’তে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেবেন। আমরা অপেক্ষায় আছি, নারীর অস্বীকৃত ও অমূল্যায়িত গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন করে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সে সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও উদ্যোগ নেওয়ার জন্য জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি (এসএনএ) সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন অর্থমন্ত্রী।

আমরা চাই নারী যেন তার গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজের জন্য সম্মানিত হন। গৃহস্থালি সব কাজ করেও তাকে যেন সবার সামনে মাথা নত করে থাকতে না হয়। কোনো সন্তান যেন মনে না করে তার মা কিছু করে না। স্বামীসহ সংসারের আর কোনো সদস্য যেন বলতে না পারে ‘তুমি সারাদিন করোটা কী’।

Comments

The Daily Star  | English

Age limit for govt job entry: 35yrs for men, 37 for women

A government committee has recommended raising the maximum age for applying for public service jobs to 35 years for men and 37 years for women.

7h ago