ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান কমেছে, বিশৃঙ্খলা বেড়েছে
ত্রুটিপূর্ণ অবৈধ যানবাহন এবং আইন অমান্যকারী চালকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান গত বছর নভেম্বর থেকে উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে সড়ক পরিবহন খাতে।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জনবলের ঘাটতি এবং নভেম্বর মাসে কার্যকর হওয়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর কয়েকটি ধারা শিথিল করার ফলে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান কমে গেছে। জরিমানা ও মামলার সঙ্গে কমেছে ভ্রাম্যমান আদালতের ডাম্পিং করা গাড়ির সংখ্যা।
কঠোর শাস্তির ব্যবস্থায় পরিবহন খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কাতেই সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান কমিয়ে দিয়েছে বলে জানান কয়েকজন কর্মকর্তা।
ফলে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মোট ভ্রাম্যমাণ আদালতের এক হাজার অভিযানে আট হাজার মামলা হয়। বছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার ২০০ অভিযানে ৩২ হাজার মামলা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট মামলা হয় ৩৩ হাজার ১১১টি।
গত ২৯ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বাজেট পরিচালনা কমিটির বৈঠকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ধীর গতি নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হন বিআরটিএ চেয়ারম্যান কামরুল আহসান।
বৈঠকে তিনি জানান, নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর প্রায় এক মাস ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বন্ধ থাকায় প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন করা যায়নি। তবে, বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে তিনি বৈঠকের আলোচনায় আশা প্রকাশ করেন।
এই অবস্থায় রাস্তায় অসংখ্য ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে।
হাইকোর্টের নির্দেশে গত বছর জুনে বিআরটিএ একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে তারা জানায়, ফিটনেস সনদ হালনাগাদ না করেই ৪ লাখ ৫৮ হাজারেরও বেশি যানবাহন রাস্তায় চলছে, যার মধ্যে রাজধানীতেই এক লাখ ৬৮ হাজার।
গত বছর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র এক লাখ ৬৫ হাজার যানবাহন তাদের ফিটনেস সনদ পুনর্নবায়ন করেছে বলে বিআরটিএ ১২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের কাছে জমা দেওয়া অপর একটি প্রতিবেদনে জানায়।
অর্থাৎ, গত বছর ৩০ ডিসেম্বরের পর থেকে রাস্তায় ফিটনেসবিহীন অন্তত দুই লাখ ৯২ হাজার যানবাহন চলছে। এই সংখ্যা ফেব্রুয়ারি মাস শেষে সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়েছে বলে বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান কমছে
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট শাখায় রয়েছে ১৩টি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদ। ট্রাফিক সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন প্রয়োগ এবং সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের পাশাপাশি তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত।
এ ছাড়া, বিআরটিএ এর অনুরোধে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরাও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকেন।
ঢাকার ১০টি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদের মধ্যে একটি পদ শূন্য রয়েছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা পাননি এবং অন্যজন দীর্ঘ সময় ধরে প্রশিক্ষণে আছেন। অন্যদিকে, চট্টগ্রামের তিনজনের মধ্যে এক জনের আছে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা।
এনফোর্সমেন্ট শাখার এক কর্মকর্তা জানান, গত তিন মাস ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মাত্র ছয় থেকে সাত জন ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন।
বিআরটিএ এর নথি ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছর জুলাই মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও মামলার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯৪ এবং ২০৭১। এ বছরের জানুয়ারিতে তা কমে ১৩৩ ও ৮৬৪ এ নেমেছে। গত বছর নভেম্বর মাসে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬১ এবং ৪৪৬।
গত বছর জুলাইয়ে ৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত, ২৪ জনকে জেল দেওয়া হয় এবং গাড়ি ডাম্প করা হয় ৩৮টি। আর, গত মাসে জরিমানা আদায় হয় ১৯ লাখ ২৫ হাজার, জেল হয় ১১ জনের এবং গাড়ি ডাম্প করা হয় মাত্র দুটি।
নভেম্বর মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাত্র পাঁচ লাখ ১৭ হাজার টাকা জরিমানা করে এবং কাউকে কারাদণ্ড দেয়নি, কোনো যানবাহনও ডাম্প করেনি।
শিথিল অবস্থানে বিআরটিএ
কঠোর শাস্তির বিধান রেখে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সংসদে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়। কিন্তু, এর বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে সড়ক পরিবহন নেতাদের বিরোধিতা থাকায় এই আইন কার্যকর করতে দেরি হয়।
গত বছর নভেম্বর থেকে মোটর যানবাহন অধ্যাদেশ-১৯৮৩ এর পরিবর্তে নতুন আইনটি প্রয়োগ করতে গেলে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন-২০০৯ এর তফসিলে নতুন সড়ক পরিবহন আইনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এর দুই সপ্তাহ পর বিআরটিএ এবং জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগের ক্ষমতা পায়। তবে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পায়নি আইনটি পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যবহারের অনুমোদন।
কারণ, যানবাহনের অননুমোদিত আকার পরিবর্তন এবং ওভারলোডিং সংক্রান্ত সড়ক পরিবহন আইনের দুটি ধারা, ভ্রাম্যমান আদালত আইন-২০০৯ এর তফসিলে নেই।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, যানবাহনের আকার পরিবর্তন পরীক্ষা এবং ওভারলোডিংয়ের বিষয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাতে না থাকায়, এ বিষয়ে তারা মামলা করতে পারেন না।
এ ছাড়া, গত বছর নভেম্বরে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই বছরের জুন পর্যন্ত আইনটির কয়েকটি ধারা শিথিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
সে কারণে, হালকা ও মাঝারি যানবাহনের লাইসেন্সধারী চালকদের ভারী যানবাহন চালানোর জন্য শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না, অবৈধ পার্কিংয়ে সাজা দেওয়ার কার্যক্রমও শিথিল রাখা হয়েছে।
সরকার ইতিমধ্যে সময়মতো যানবাহনের লাইসেন্স এবং ফিটনেস সনদ পুনর্নবায়ন না করার জরিমানা মওকুফ করেছে।
বিআরটিএর এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘তাদের জুন পর্যন্ত সময় দেওয়ার হয়েছে বলে আমরা এখন নামমাত্র জরিমানা করছি।’
‘আসলে, মোটা অংকের জরিমানা করলে পরিবহন খাতে নতুন করে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি আমরা,’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্য ডেইলি স্টারকে জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন কাগজপত্র হালনাগাদ করার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা আশা করছি চালকরা সময়সীমার মধ্যে কাগজপত্র হালনাগাদ করবেন।’
বিআরটিএ এর বক্তব্য
ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান কমে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন বিআরটিএ এর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) এ. কে. এম. মাসুদুর রহমান।
কারণগুলি হলো: যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের যথাসময়ে তাদের লাইসেন্স ও ফিটনেস নবায়ন না করার জরিমানা মওকুফ করা, হালকা লাইসেন্সধারী চালকদের জুন পর্যন্ত ভারী যানবাহন চালানোর অনুমতি দেওয়া এবং ভ্রাম্যমান আদালতের যানবাহনের বিধিবহির্ভূত আকার পরিবর্তন ও ওভারলোডিংয়ের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা না থাকা।
২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘নতুন আইন কার্যকর হওয়ার পর, মন্ত্রী ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করতে বলেছেন। তাই আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি না।’
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে এটা অর্জন করা ‘কঠিন’ হবে বলে তিনি জানান।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান কামরুল আহসান বলেন, ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা কম হওয়ায় অভিযানও কম হচ্ছে।’
তবে, ফেব্রুয়ারি থেকে অভিযানের সংখ্যা বেড়েছে, তিনি জানান।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে আমাদের খেয়াল আছে এবং আমরা তা অর্জনে সচেষ্ট আছি।’
Comments