সেবা প্রকাশনী: ৫৫ বছরেও আকর্ষণ কমেনি এতটুকু

নিষ্ঠুর এক দানবের মুখে জিম্মি হয়ে আছে বিশ্ববাসী। গল্পের নায়ক এখন কী করবে? পৃথিবীর অসহায় মানুষগুলোকে কি সে বাঁচাতে পারবে?
Seba Prakashani
অমর একুশে বইমেলায় সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনে ক্রেতারা। ছবি: পলাশ খান

নিষ্ঠুর এক দানবের মুখে জিম্মি হয়ে আছে বিশ্ববাসী। গল্পের নায়ক এখন কী করবে? পৃথিবীর অসহায় মানুষগুলোকে কি সে বাঁচাতে পারবে?

টান টান উত্তেজনার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা এসব রোমাঞ্চকর থ্রিলার কিশোর জীবনের অন্যতম অংশ। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে রোমাঞ্চকর সব বিদেশি গল্পের বাংলা অনুবাদ মানুষের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে সেবা প্রকাশনী। এতগুলো বছর পার হলেও এখান থেকে প্রকাশিত হওয়া বইয়ের কদর একটুও কমেনি।

অপরাধ, থ্রিলার, গোয়েন্দাকাহিনী কিংবা রহস্য— এসব উপন্যাস খুঁজতে আসা বইপ্রেমীদের মূল আকর্ষণ বইমেলার সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণের ৬৪৮-৬৪৯ নম্বর স্টল। এখানে রঙিন সব বই সাজিয়ে পাঠকের হাতে পছন্দের বইটি তুলে দিচ্ছে সেবা প্রকাশনী।

ছুটির দিন সকালে শিশু প্রহরে অনেক মা-বাবাই তাদের সন্তানকে নিয়ে মেলায় আসেন। বাচ্চাদের স্বাধীনভাবে বই কিনতে দিয়ে কোনো এক ফাঁকে তারা শৈশবের স্মৃতি রোমন্থনের জন্য সেবা প্রকাশনীতে ছুটে আসেন।

বেশ কয়েকবার মেলা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সবসময়ই স্টলটিতে পাঠকরা ভিড় করে আছেন। অন্যান্য স্টলের তুলনায় সেবা প্রকাশনীর স্টলটি কিছুটা আলাদা। এই স্টলে সামনে টেবিল পেতে তার উপরে বই সাজানো হয়নি। বইপ্রেমীরা ক্যাটালগ দেখে বই বাছাই করেন। কোনো বই সম্পর্কে আগ্রহী হলে বিক্রয়কর্মীকে সেই বইটি দেখাতে বলেন। শেলফে সাজিয়ে রাখা বইগুলো থেকে পছন্দের বইটি পাঠকের হাতে তুলে দেন বিক্রয়কর্মীরা।

সেবার মোড়ক হাতে প্রায় সবাইকেই গালভরা হাসি নিয়ে স্টল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।

এমনই একজন তাসলিমা আনোয়ার। বর্তমানে তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমি সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই তিন গোয়েন্দা পড়ি। এখন আমার ছেলেকেও আমি কিশোর, মুসা এবং রবিনের পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।’ ১০ বছর বয়সী সবুজের জন্য বইমেলা থেকে তিন গোয়েন্দা সিরিজের ভলিউম ১ ও ২ কিনেছেন মগবাজারের এই বাসিন্দা।

ইংরেজি গোয়েন্দা উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তিন গোয়েন্দা। রকিব হাসানের হাতে যাত্রা শুরু করে তিন অপরিণত গোয়েন্দা কিশোর-মুসা-রবিন। অসংখ্য পাঠককে উপন্যাসের রঙিন দুনিয়ায় নিয়ে যেতে সফল হয়েছেন তিনি। শামসুদ্দীন নবাব দায়িত্ব নেওয়ার আগে এই সিরিজের ১৬০টি গল্প লেখেন রকিব হাসান।

এই স্টল থেকে ১৬টি বই কিনেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমি স্কুল থেকেই এই সিরিজটি পড়ছি। প্রকাশিত হওয়া সবগুলো বই-ই আমার পড়া।’

বিশটি বই হাতে মেলায় ঘুরছিলেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা রায়হান সাদিক। ছেলের জন্য বেশ কয়েকটি কিশোর ক্লাসিক এবং গোয়েন্দা উপন্যাস কিনেছেন বলে জানান তিনি।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় গর্বের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি সেবার অনুবাদ করা ক্লাসিক উপন্যাসগুলোর অন্ধভক্ত ছিলাম। আমার ছেলেও তার বাবার মতো দিনদিন এই উপন্যাসগুলোর ভক্ত হয়ে উঠছে।’

গর্বিত এই বাবার ছেলে আরমান মালিক পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। সে বলে, ‘তিন গোয়েন্দার ভলিউম কেনার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলাম। পাশাপাশি আমি হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, মার্ক টোয়েন এবং রবার্ট লুই স্টিভেনসন এর বইও কিনেছি।’

এই প্রকাশনীর অন্যতম আকর্ষণ মাসুদ রানা। প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৬৬ সালে প্রথম মাসুদ রানার গল্প লিখেছিলেন। এতো বছর পরেও সিরিজটি এখনো পাঠকদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।

৮৩ বছর বয়সী এই লেখক বইমেলার মাসে মাসুদ রানা সিরিজের ৪৬৩তম বই ছায়া ঘটক প্রকাশ করেছেন।

গোপন মিশনে বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ানো বাংলাদেশি গুপ্তচর রানার বীরত্বপূর্ণ কাহিনী নতুন-পুরাতন সব পাঠককেই সমানভাবে আকৃষ্ট করে চলেছে। এই থ্রিলারের পটভূমি পাশ্চাত্য উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত। তবে, সেটা একেবারেই বইয়ের অনন্যতাকে ক্ষুণ্ণ করেনি।

স্টলের কর্মী মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কেবল পুরোনো সংস্করণ নয়। পাঠকরা নতুন সংস্করণও কিনছে। পাঠকদের মধ্যে তিন গোয়েন্দা এবং মাসুদ রানার নতুন বই দুটির চাহিদা অনেক বেশি।’

অনেকেই অবশ্য এই বইমেলায় তাদের প্রিয় অনেক বইয়ের নতুন সংস্করণ না আসায় অভিযোগ করেছেন। সবসময়ই পাঠকের চাপে থাকা কর্মীরা জানিয়েছেন, খুব শিগগির তারা ওই বইগুলো সেগুনবাগিচার অফিস থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।

ব্যস্ত স্টলটিকে ঘিরে সবসময়ই চলে পাঠকদের প্রাণবন্ত কথোপকথন। ‘মাসুদ রানার বইতে সবই আছে। রানা যতটুকু নির্মম, ততটুকুই সংবেদনশীল। আর এজন্যই তার মানুষ মারার লাইসেন্স আছে,’ হাসিমুখে স্বামী অমল দত্তকে বলছিলেন আরতি দত্ত।

জবাবে অমল জানান, ‘হতে পারে। তবুও আমি কাজী মাহবুব হোসেনের ওয়েস্টার্ন বই-ই বেশি পছন্দ করি।’

প্রাণবন্ত এই কথোপকথনের মধ্যেও স্টলের চারদিক থেকে আরও অনেক মানুষের সাহিত্য আলোচনা শোনা যেতে থাকে। কেউ ঝুঁকছেন তিন গোয়েন্দার দিকে। কেউ আবার ইংরেজি ক্লাসিক উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ বেছে নিচ্ছেন। কিশোররা খুঁজে বেড়াচ্ছেন থ্রিলার কিংবা রহস্যের বই।

পছন্দ যা-ই হোক না কেন, একটি বিষয় নিশ্চিত— পাঠকের হৃদয়ে সেবার বইগুলো চিরকাল বেঁচে থাকবে। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে যাবে। ঠিক যেমনটা সেবা প্রকাশনীর স্লোগানে দেখা যায়, ‘সেবা বই, প্রিয় বই, অবসরের সঙ্গী।’

Comments

The Daily Star  | English

Age limit for govt job entry: 35yrs for men, 37 for women

A government committee has recommended raising the maximum age for applying for public service jobs to 35 years for men and 37 years for women.

10h ago