বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতি রোধ করতে পারবে না করোনাভাইরাস

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রভাবিত হলেও চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২০ শতাংশ অর্জনে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না বলে সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও সহায়ক আর্থিক নীতির ওপর ভর করে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ।
দেশের অর্থনীতির ওপর নতুন এই ভাইরাসের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে রেমিট্যান্সের জোরালো প্রবাহ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। সম্প্রতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়।
এছাড়াও, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, মেগা প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফলে, জিডিপি বৃদ্ধির হার এর বর্তমান গতি বজায় রাখবে।’
তবে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ও সামগ্রিক বাণিজ্যে এই ভাইরাসের প্রভাব কতটা পড়বে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, এর প্রভাব মার্চ মাসে স্পষ্ট হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন মতে, ‘অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের স্বল্পমেয়াদী প্রভাব যে পড়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্ব অর্থনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।’
বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ও কাঁচামালের সবচেয়ে বড় উৎস বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের আমদানির এক-পঞ্চমাংশ অর্থাৎ ৫৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মালামাল চীন থেকে আমদানি করে বাংলাদেশ।
এ কারণেই, সিওভি-১৯ নামের এই মহামারি করোনাভাইরাসের উৎসস্থল চীন থেকে বর্তমানে কাঁচামাল আমদানি বাধা পাওয়ায়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানি খাত ও ব্যাহত হচ্ছে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা। এর ফলে দেশের মুদ্রাস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল, সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যালস উপাদানগুলির (এপিআই) ২৬ শতাংশ সরবরাহ করে চীন। যদি এপিআই সরবরাহ থমকে যায়, তবে ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হবে। এর প্রভাব পড়বে ওষুধ রপ্তানিতে।
চীনা সংস্থাগুলি যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে, সেগুলোও সমস্যার মধ্যে পড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেল, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প ও পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ।
কেস স্টাডি হিসেবে, প্রতিবেদনে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। দুটি চীনা নির্মাণ সংস্থা মূল সেতু নির্মাণ এবং নদীর ড্রেজিংয়ের কাজ বাস্তবায়ন করছে।
মূল সেতুর ঠিকাদার চীন মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সদরদপ্তর করোনাভাইরাসের কেন্দ্রস্থল হুবেই প্রদেশের উহান শহরে।
কোম্পানিটি সেখানে গত এক মাস ধরে তার কার্যক্রম সীমিত করে ফেলেছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম এই অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতিতে।
প্রকল্পের অধিকাংশ নির্মাণ সামগ্রী চীন থেকেই আনা হচ্ছে এবং বেশিরভাগ সরবরাহকারী হুবেই প্রদেশের। সুতরাং, অনেক চীনা কারখানা বন্ধ থাকায় ও চীন থেকে আসা জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নির্মাণ সামগ্রীর নিয়মিত আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
চীন থেকে আমদানি করা প্রথম সাতটি পণ্য হচ্ছে— সুতা, ওভেন টেক্সটাইল কাপড়, নিট টেক্সটাইল কাপড়, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ, মোবাইল যন্ত্রাংশ, আপেল ও রসুন। দেখা যাচ্ছে, প্রথম চারটি পণ্যই বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ রফতানি পণ্য পোশাকশিল্পের কাঁচামাল।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সুতা, ওভেন টেক্সটাইল কাপড়, নিট টেক্সটাইল কাপড় ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজ আমদানি করে। ইতোমধ্যে, এই অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পণ্য আমদানি করা হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে সরবরাহ ব্যাহত হলে পোশাকশিল্পের কাঁচামাল আমদানির বিকল্প উৎস সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা উচিত।
তবে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে মোবাইল যন্ত্রাংশ আমদানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত সাত মাসে ৫০৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের যন্ত্রাংশ আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের মাত্র ২৭ ভাগ।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রসুন আমদানি করেছে। আমদানিকারকরা আদা, রসুন এবং দারুচিনি আনছেন মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং মিশর থেকে।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে চীন থেকে রসুন ও আদা আমদানি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে স্থানীয় বাজারগুলিতে সরবরাহের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য চীনে যায় এমন নয়। তবে, সেখানে রপ্তানি পণ্যের বাজার ক্রমবর্ধমান। চীনে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং কাঁকড়া ও ইল মাছ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চীনে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের অর্ধেক এ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পাঠানো হয়ে গেছে। ফলে, চীনে পণ্য রপ্তানির তেমন বড় কোনও ঝুঁকি নেই এবং অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে চীন থেকে আসা জাহাজগুলোকে কমপক্ষে ১০ দিন ‘কোয়ারেন্টাইন’ করতে হচ্ছে বলে আমদানি করা পণ্যগুলো খালাস করতে দেরি হচ্ছে।
চীন থেকে আকাশপথে যোগাযোগ সীমিত হয়ে যাওয়ায় মানুষের চলাচল কমে গেছে। ফলে, উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে হোটেল বুকিং।
বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয় লাখ পর্যটক আসেন। তাদের বেশির ভাগই আসেন চীন থেকে। এখন এ সংখ্যাও কমে যাবে।
করোনাভাইরাস কারণে সামগ্রিক বাণিজ্য কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চলতি অর্থবছরে সামগ্রিক রপ্তানি আয় কমে গেলেও, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে গত দুই বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশের ঘাটতি ভালো অবস্থানে আছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত অভিবাসী শ্রমিকরা ১১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম কমে যাওয়ার কারণেও বাংলাদেশ উপকৃত হবে।
মহামারির কারণে তেলের দাম ১৪ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ এ কারণে চলতি অর্থবছরে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। এটি দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য ও মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পেট্রোলিয়াম ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করে।
Comments