কেন পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়!

যে বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য আমি এই লেখাটা শুরু করেছি, সেই বিষয়—কবিতা। ঘটনাক্রমে আমি পড়ি। খুব একটা পড়ার আগ্রহ থেকে পড়ি না।

নতুন কবিতার বই পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়, বলা ভালো বইটার বেশিরভাগ কবিতা আমাকে নাড়া দিতে পেরেছে। আমার সংবেদনশীলতা যে জায়গা থেকে কাজ করে ও প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেই জায়গাটা স্পর্শ করতে পেরেছে। আর এ কারণেই আমি এটা নিয়ে কথা বলছি।

কবিতা হচ্ছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ধরনের আর্ট। এই কথাটার পেছনে আমার যুক্তি বা আমার দৃষ্টিভঙ্গি আগে পরিষ্কার করি। আমাদের মানুষদের এই জগৎ, এই মহাবিশ্ব, এই মহাবিশ্বের সবকিছু মৌলিকভাবে যে জিনিস দিয়ে তৈরি সেটা হচ্ছে ভাষা। আমরা যা কিছু করি, যা কিছু দেখি, যা কিছু ভাবি, আমাদের সকল স্মৃতি সবকিছুই আমাদের মস্তিষ্কে ভাষার মাধ্যমে প্রক্রিয়া হয়। মানুষের মস্তিষ্ক বা কগনিটিভ সিস্টেম ইনপুট হিসেবে ভাষাকেই গ্রহণ করে এবং প্রক্রিয়া করে ভাষাকেই আউটপুট হিসেবে বের করে। আমরা যখন কিছু দেখি, আমাদের মস্তিষ্কে ভাষা হয়ে সেই দৃশ্য তৈরি হয়। আমাদের মস্তিষ্ক যখন কোনো স্মৃতি তৈরি করে, সেই স্মৃতিও ভাষা দিয়েই সংরক্ষিত হয়।

আর এই ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো, এর নিয়ম বা সিনট্যাক্স। মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মস্তিষ্ক—আমাদের কগনিটিভ সিস্টেম কাজ করে এই সিনট্যাক্সের যুক্তিতে। একজন মানুষ যখন একদম ছোট থেকে বড় হতে থাকে, সে যখন ভাষা শিখতে থাকে তখন সেই ভাষার মাধ্যমে তার মস্তিষ্কের প্রোগ্রামিং হয়। সিনট্যাক্স, অর্থাৎ কোন শব্দের পর কোন শব্দ কীভাবে বসে অর্থ তৈরি করবে—সেই লজিক দিয়েই আমাদের মস্তিষ্ক পরবর্তীতে কাজ করতে থাকে। দেখবেন, একজন পাগলও যখন কথা বলে, সে সিনট্যাক্সের বাইরে কিছু বলে না। হয়তো তার কথার প্রেক্ষাপট ঠিক নেই, কিন্তু সিনট্যাক্স ঠিক আছে। মানুষ আগুন জ্বালাতে শেখার পর না, যেদিন মানুষ প্রথম ভাষা ব্যবহার করেছিল সেদিনই সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। 

তো, কবিতার সঙ্গে ভাষার সিনট্যাক্সের ক্ষমতার কী সম্পর্ক? কবিতা এই সিনট্যাক্সের ক্ষমতা ও কার্যকারিতাকে সবচেয়ে যথাযথভাবে ব্যবহার করে। সিনট্যাক্সকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করে, খুব সামান্য আয়োজন করে, খুব অল্প চেষ্টায় অনেক বিরাট অর্থ বা মেসেজ বা কথা বলে দেয়। অন্য কোনো আর্ট ফর্ম ব্যবহার করলে যেটা করতে বিরাট আয়োজনের দরকার হতো। সিনট্যাক্সের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে সেই আর্ট ফর্ম এত ভালোভাবে বা এত যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারত না। এবং এভাবে কবিতা ভাষার নতুন নিয়ম বা নতুন সিনট্যাক্সও তৈরি করে।

যেমন, যে বইয়ের কবিতা নিয়ে আমি লিখছি সেখান থেকেই উদাহারণ দেই-

‘অ্যালেক্সা, যুদ্ধ কি বাস্তবেই হয়েছিল,

বাস্তবেই অগ্নিশালায় কুশাসনের ওরা

কথা বলছিল ক্রুজার ডেস্ট্রয়ার নিয়ে?

তুমি সেই নদীর নামটুকুই জানো

কপোতাক্ষ সেটা,

দেখি ক্রুজারের নাম কী ছিল বলো,

সেই সাবমেরিন সেই টর্পেডো-বুলেট...

তোমার কথামেশিনও কি ওদেরকে ডাকে ‘কমরেড’?

ওকে!

দেখি বলো তাহলে তোমার ওই একঘেয়ে সুরে একটানে

এই জীবনের মানে।’

 

অ্যামাজনের অ্যালেক্সা যন্ত্রটিকে এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে কোনো একটা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে। ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধের ঘটনা এখানে তৈরি করা হয়েছে কেবল কয়েকটা নৌ-যুদ্ধযানের কথা বলে। মজার ব্যাপার হলো, সেই যুদ্ধাস্ত্রগুলোর মধ্যে হঠাত করে কি যেন উদ্দেশ্যে কপোতাক্ষ নদীর নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথায় অ্যালেক্সা, কোথায় ক্রুজার আর সাবমেরিন আর কোথায় যশোরের কপোতাক্ষ। কিন্তু এই সবকিছু দিয়ে একটা ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে অ্যালেক্সাকে। চরম ক্ষমতাবান মেশিনের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। মেশিন মানে যেকোনো যন্ত্র—সেটা অ্যালেক্সাই হোক বা বা ‘সাবমেরিন-টর্পেডো-বুলেট’; ‘তোমার কথামেশিনও কি ওদেরকে ডাকে ‘কমরেড’?’

কিন্তু পরের লাইনেই এসে পুরো দৃশ্য বদলে গেছে, কারণ অ্যালেক্সা এখানে কোনো বিষয়ই না, সম্বোধন করার জন্য একটা সাবজেক্ট মাত্র। বরং এখানে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন- অ্যালেক্সাকে জিজ্ঞাসার ভান করে, মানবজাতিকে বা নিজেকেই বিদ্রুপের সাথে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে-

“ওকে!

দেখি বলো তাহলে তোমার ওই একঘেয়ে সুরে একটানে

এই জীবনের মানে”

 

মানে, এই জীবনের মালিক, যে 'আমি' কথা বলছে, সে নিজেই তার জীবন ও বহুকাল ধরে ঘটতে থাকা এতসব ঘটনার অর্থ ও উদ্দেশ্য জানেনা, আর অ্যালেক্সা তুমি আসছো বাহাদুরি দেখাতে! কতটা মারাত্মক বোকা তুমি অ্যালেক্সা!

তৃতীয় ব্যাক্তি অ্যালেক্সাকে বলার ভান করে, যে বলছে সে নিজেই একটা সাবজেক্ট হয়ে গেল—একই পংক্তির মধ্যে—মাত্র একটা লাইনের ব্যবধানে, শুধু সিনট্যাক্সকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করে, বলার ভঙ্গির মধ্যে একটা ধাঁধা বা হেঁয়ালি তৈরি করে।

বাংলা বা যেকোনো কবিতার যে প্রচলিত ভাষা, এই বইয়ের কবিতা সেটা থেকে আলাদা। আর এই ২০২০ সালে এসে সময়ের যে স্বাদ ও গন্ধ, এই বইয়ে সেটা আছে; ২০১৯-২০ সালে, আশি বা নব্বইয়ের দশকের বাতিল হয়ে যাওয়া স্বাদ এই বইতে অন্তত পাওয়া যাবে না।

এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতা আমাকে কেন নাড়া দিলো! আমার কাছে কেন অসাধারণ মনে হলো! অ্যালেক্সা কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সের মতো আধুনিক ও সময়োপযোগী জিনিস এসেছে এই কারণে? সিনট্যাক্সের ধাঁধা আছে, এই কারণে? না। সরল উত্তর—কবিতার বিষয় ও কবিতার সাটেলটি বা সূক্ষ্মতার কারণে। কবিতা বা যেকোনো আর্টের অসাধারণ হয়ে ওঠার পেছনে দুটি জিনিসের গুরুত্ব অনেক বেশি—উইট বা বুদ্ধিমত্তা ও সাটেলটি বা সূক্ষ্মতা। উইট তো আছেই, যে বিষয়গুলো নিয়ে এই বইয়ে কথা বলা হয়েছে, সেগুলো এত সূক্ষ্মভাবে বলা, প্রশ্ন করা, চ্যালেঞ্জ করা এবং সবচেয়ে বড় কথা, বিদ্রুপ করা—সাধারণত কোথাও পাওয়া যায় না।

এই বইয়ের দুই-একটা ছাড়া বলা যায় প্রায় সব কবিতাই দার্শনিক নয়তো রাজনৈতিক। যে কবিতাগুলো রাজনৈতিক সেগুলোও কোনো একটা পর্যায়ে একটা দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে আসছে; আবার যে কবিতাগুলো দার্শনিক কোনো একটা ধারণাকে প্রশ্ন করছে সেটাও কোনো এক পর্যায়ে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। যেমন, ‘জীবনের মানে’ কবিতাটি একটা দার্শনিক চেতনা থেকে আসা। ‘জীবনের মানে’ নিয়ে যদি কবিতা লেখা হয়, সেটা নিশ্চিতভাবেই একটা দার্শনিক কিছু লেখার চেষ্টাই হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে কবিতাটার যাত্রা মূলত একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া, দার্শনিক ভূমিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। অনেক দীর্ঘ সময়ের মাপকাঠি দিয়ে ইতিহাসকে দেখলে কিংবা অনেক উপর থেকে দেখলে বোঝা যায়, কোনো একক ব্যক্তির জীবনের মানে বলে কিছু নেই। কারণ একজন ব্যক্তিসত্ত্বা বলে কোনো কিছুকে আলাদা করা যায় না। একটা জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই সামগ্রিকভাবে তাদের জীবনের মানে হয়ে উঠে। এখানে বলা হয়েছে, হিটলারের আমলে নাৎসিদের জীবনের মানে ছিল হিটলারের নাৎসিবাদ, মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটা হয়ত হতে পারে ইমাম মাহদীর জন্য অপেক্ষা। কিন্তু পরে এই কবিতাটা আরও বড় একটা রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে নিয়ে গেল। এক বর্ণবাদী জার্মান জেনারেল, যার এশিয়ান, আফ্রিকান ও মুসলিমদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা—তাঁর বক্তব্য কবিতায় এল। কিন্তু, মজার ব্যাপার,  জার্মান জেনারেলের এই ঘৃণাটাও কোনো একজন ব্যক্তির একক অনুভূতি না, বরং তা পুরো পাশ্চাত্যের এই এশিয়া, আফ্রিকা ও মুসলিমদের প্রতি সামগ্রিক একটা অনুভূতি। কখনো মোলায়েমভাবে চাপা দেওয়া, কখনো কুৎসিতভাবে প্রকাশিত।

একইভাবে ‘সম্ভবত আক্রোশ থেকে’ নামের কবিতার কথাও বলা যায়। ‘আমি কে’ দার্শনিকভাবে এই ক্লিশে অথবা ক্লাসিক প্রশ্ন এখানে এসেছে তবে, দার্শনিক কোনো ধারণার ধারেকাছেও যাওয়া হয়নি। এখানে 'আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ নিয়ে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপ করা হয়েছে। একজন মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, শ্রেণিগত, পারিবারিক, পলিটিক্যাল, জাতিগত এত এত পরিচয়ের কারণে পৃথিবীতে এত বিশৃংখলা তৈরি হচ্ছে, কেউ এই পরিচয় ব্যবহার করে আক্রমণ করছে, কেউ আবার এই পরিচয়ের কারণেই আক্রমণের শিকার হচ্ছে।

এই বইয়ের প্রায় সব কবিতাই রাজনৈতিক ও দার্শনিক বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। সব কবিতায়ই রাজনৈতিক বক্তব্য ও দার্শনিক বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করার মিশ্রণ ঘটেছে। আর সেই কাজ করতে গিয়ে কবি মাসরুর আরেফিন, কোনো নির্দিষ্ট ডিসকোর্সের বা বক্তব্যের ভেতর দাঁড়িয়ে নেই, বা কোনো একটা ধারণার মধ্যেও আবদ্ধ থাকেননি। বিশেষ করে বইয়ের প্রথম ও শেষের দিকের কবিতায় উনি একটা কসমিক, একক ভয়েসে, অনেক উপর থেকে, অনেক বড় একটা টাইম ফ্রেমে দেখছেন বলে মনে হয়। কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা বা উদাহরণ নিয়ে আসলে সেটাও উনি একটা মহাকালের, মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন। অনেকটা এরকম- মানবজাতি তোমরা তো অনেক কথাই বলছো, অনেক সিরিয়াস ভাব দেখাচ্ছো, কিন্তু তোমার এই সবকিছুই তো একটা আত্মপ্রবঞ্চনা। তুমি যতই পাশ কাটাও, তোমার এই সবকিছুর যে কোনো মানে নেই, এই সবকিছু যে তোমাকে কোথাও নিয়ে যাবেনা- এর চেয়ে বড় সত্য তো আর নেই। সরাসরি বললে, উনি স্ক্রিপচারের ভঙ্গিতে কথা বলছেন। বাইবেল- ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট বা ধর্মগ্রন্থের যে ভঙ্গি। ধর্মগ্রন্থের এই ভঙ্গিটাই কবিতাগুলোর একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য, এবং সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। বাংলা ভাষায়, ধর্মগ্রন্থের এই কসমিক ভঙ্গিতে এত সাবলীল বা স্বচ্ছন্দভাবে লেখার উদাহারণ আর নাই। আমি আর সব বাদ দিয়ে, শুধু এই একটা কারণ, শুধু এই স্ক্রিপচারের কসমিক ভঙ্গির জন্য বইটাকে প্রাধান্য দেব।

 

এই বইয়ের ‘রিক্ততা’ একটি শক্তিশালী কবিতা। এখানে চরিত্রদের নাম, ঘটনা ও ভৌগলিক বর্ণনা পড়ে মনে হয় এখানে বিপরীত বা উলটা-এক্সোডাসের মতো কিছু একটা তৈরি হয়েছে। মুসা নবীর নেতৃত্বে হিব্রু জনগোষ্ঠী লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে যে মহিমান্বিত এক্সোডাস ঘটিয়েছিল, এখনকার দুনিয়ার এই অর্থহীন, নিষ্ঠুর রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সেটার সংযোগ পাওয়া যায়। হয়ত তাদের কারণেই, এই একবিংশ শতাব্দীতেও একদল উদ্বাস্তু মানুষের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। অবর্ণনীয়, কিন্তু বাস্তব।

 

“যখন আর্মার্ড বক্সার ভেহিকলগুলো লাইম পাড়তে আসে,

কেমন হুম হুম শব্দ আসছে দূরের ওই

কান্ডারী-হারানো জাহাজের থেকে,

রানিম আবুদকে ডেকে ডেকে বলছিল,

আমাকে নিয়ে যেয়ো, বাবু, আমাকে নিয়ে যেয়ো সাথে,

কেমন খ ধ্বনির হাসি চাপছিল ফটো সাংবাদিক মেয়েটা নিজেই পানিতে পড়ে গিয়ে,

তখনই বাঁশি—আমাদেরকে বলা হলো পন্টুনের থেকে দূরে সরে যেতে।

আমিও এই ফাঁকে কবিতা লেখার অবকাশ পেয়ে

বুঝলাম পৃথিবী শূন্য পৃথিবী ফক্কা পৃথিবী ফোঁপরা বটে;”

 

এরকম অসংখ্য উদাহারণ পাওয়া যাবে এই বইয়ের অনেক কবিতায়, অনেক লাইনে। যেমন ভোরের গল্প কবিতাটা, এটা পুরাই একটা কেয়ামত।

“তো, সেইখানে দেখি মেঘের একপাশে কী গাঢ়

লাল আভা, অগ্নিগিরি যেন, অন্য পাশ কালো,

পৃথিবী তবু শান্ত বটে, জাগছে দূরে

বনশ্রী-রামপুরা দিগন্তরেখা ধরে—

মনে হলো ব্যাপারটা এমনই কি হবে মহাপ্রলয়ের দিনে?

এরকম বিভ্রান্তকরই হবে তবে, যেভাবে আগুন

লেগেছে বলে মনে হচ্ছে প্রথম সারির মেঘেদের পেছনের দিকে?—

হাহ্ আজকেই কি সেই মহাপ্রলয়ের দিন না-কি?”

 

এরকম বহু বহু উদাহারণ আছে।

 

যেমন “এটাও বিশ্বাস করো, ওইটাও করো, এই তো চেহারা!

আর জীবনে যা যা করেছ খোকা তুমি,

তার দাম দিতে হবে না বলো?”

 

এখানে এসে- এই কসমিক স্বরের কারণে আমার একটা স্প্যানিশ প্রবাদের কথা মনে পড়েছে- “Take what you want and pay for it, says God.”

“আর জীবনে যা যা করেছ খোকা তুমি,

তার দাম দিতে হবে না বলো?”

 

জীবনে সবকিছুই করা যাবে, যা খুশি তাই, শুধু তার উপযুক্ত দামটা পরিশোধ করতে হবে।  এর চাইতে বেশি সরল এবং অনিবার্য আর কী হতে পারে?

এই বইয়ের অনেক কবিতাতে প্রকৃতি খুব বড়ভাবে এসেছে, খুব তাতপর্যপূর্ণভাবে ‘এতগুলি ব যেহেতু আছে’ কবিতাতে পাখিদের নিয়ে এ পর্যবেক্ষণ সেটা চমৎকার। আমার মনে হয়েছে পাখিদেরকে দেখার ভঙ্গিটাও একরকম কসমিক দেখার ভঙ্গি।

“এসব ভাবছি এলোমেলো আর দেখছি যে

বড় ডানার ছোট ও সুতীক্ষ্ণ কিছু পাখি

জোর চিৎকার তুলে সাঁ-সাঁ উড়ে এসে

আছড়ে পড়ছে মেহগনি জাম জারুলের গাছে,

এমন যে মনে হয় এ-পৃথিবীতে

মানবপ্রজাতি নিয়ে শেষ ভাবনাটুকু

মানুষ নয় পাখিদেরই ভাবা হয়ে গেছে। “

অথবা-

“ভোরে চোখ খুললেই না জানি মহাপ্রলয় দেখা হয়,

এমন যেন সামনে এক নিঃসীম শূন্য মাঠ

যেখানে থাকবে সাদা বালির পরে বালি

যেমন এখানে রয়েছে এই বালু নদীর পাড়ে—

সেখানে সন্ধ্যায় পাখি ওড়ে

পাখিরা উদ্ধত আস্ফালিত ওড়ে।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের  নিয়ে করা ওয়ের্নার হেরজগের একটা বিখ্যাত ডকুমেন্টারী আছে- নাম, Into the abyss;  সেই ডকুমেন্টারীর শেষে একজন যাজক বলে - "Once you feel good about your life, you do start watching what the birds do. What the doves are doing. Like the hummingbirds. Why there are so many of them!"

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে একজন যাজক জীবনের অর্থহীনতা বা অসাড়তার কথা বুঝে গেছে। তারপর সে পাখিদেরকে কৌতূহল নিয়ে দেখছে। তার সাথে এখানে পাখিদের উদ্ধত আস্ফালিত উড়াউড়ি দেখতে থাকা কবির কী সুন্দর মিল!

প্রকৃতি আরো ব্যাপকভাবে এসেছে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে যে কবিতা লেখা হয়েছে সেটাতেও। জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা বাংলা ভাষার সবচেয়ে সেরা লেখা এই ‘ছাতু’ কবিতা- কোনোভাবেই এটা আমার অত্যুক্তি নয়।

এই বইয়ে দুটি কবিতা আছে যেটা খুব একটা বিশুদ্ধ ভয়ের মুখোমুখি ফেলে দেয়। “কেন চিনতে পারছি না কোনোকিছু” ও “কোনো এক বনের কিনারে”।

এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতা নিয়েই আক্ষরিক অর্থেই অনেক কথা বলা যায়। এগুলো এতটাই শক্তিশালী এবং আলাদা। ব্যক্তিগত কথাবার্তা ও নৈমিত্তিক স্বরের যে গতানুগতিক ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা কবিতার ক্ষেত্রে পাওয়া যায় সেটা এখানে পাওয়া যাবেনা।

এই বই আপনাকে অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে। একটা ভৌগলিক-ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-দার্শনিক-বিদ্রুপাত্মক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দিবে, আর সেই ভ্রমণ যদি পুরোপুরি শেষ করা যায় তাহলে হয়ত মনে হবে- যেটা এই বইয়ের সব কবিতাই কোনো না কোনোভাবে প্রমাণ করেছে- মানুষের জীবন এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা, তবুও এটা অর্থহীন একটা ব্যাপার, সম্ভবত!

বই: পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়

লেখক: মাসরুর আরেফিন

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০

প্রকাশক: প্রত্যয় ইসলাম

প্রকাশনা: সমাবেশ

স্বত্ব: ফারহানা মাসরুর

প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ

মুদ্রিত পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৮৫

মূল্য: ২৫০ টাকা

 

গ্রন্থ সমালোচক: আশরাফুল আলম শাওন। পেশায় আইটি প্রফেশনাল। পড়াশোনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago