ভালোবাসাটা একধরনের প্রতিজ্ঞা

জাতিসংঘের সদরদপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে— ফেসবুকে এরকম একটি সংবাদে চোখটা আটকে গেল। সঙ্গে ভিডিও ছিল। ভিডিওতে দেখলাম দেশি-বিদেশি স্টাফরা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে হারমোনিয়াম, বাঁশি বাজিয়ে গাইছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’
‘বাবার কবর নাই তাতে কী হয়েছে, পলাশ গাছটাই আমার কাছে বাবা হয়ে, বাবার কবর হয়ে থাকে প্রতিদিন।’ ছবি: শাওন মাহমুদের ফেসবুক থেকে নেওয়া

জাতিসংঘের সদরদপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে— ফেসবুকে এরকম একটি সংবাদে চোখটা আটকে গেল। সঙ্গে ভিডিও ছিল। ভিডিওতে দেখলাম দেশি-বিদেশি স্টাফরা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে হারমোনিয়াম, বাঁশি বাজিয়ে গাইছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম নিজের অজান্তে চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এটি এমন একটি গান, যে গান যেকোনো অবস্থাতেই শুনি না কেন, আমার বুকটা ভরে যায়। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। এত ভালোবাসা এই গানের সুরে, কথায়। আর যখন দেখলাম জাতিসংঘে বিদেশিরা বাঙালিদের পোশাক পরে এই গানটি গাইছে— তখনকার অনুভূতিটা সহজেই অনুমেয়।

ঠিক এর পরপরই দেখলাম আরেকটি স্ট্যাটাস। সেখানে লেখা, ‘বাবার মৃত্যুদিন নেই, কবর নেই। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবার নামে একটা পলাশ গাছ বুনেছিলাম আমরা কয়জনা, শহীদ মিনার চত্বরের মাঝে। নিজের টাকায় চারা, লোহার গ্রিল আর ব্যানার তৈরি করে দিয়েছিলাম। বাবার কবর নাই তাতে কী হয়েছে, পলাশ গাছটাই আমার কাছে বাবা হয়ে, বাবার কবর হয়ে থাকে প্রতিদিন।’ এই স্ট্যাটাসটি শাওন মাহমুদের। শাওন মাহমুদ, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা। আলতাফ মাহমুদ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’— এই অসাধারণ গানের সুর দিয়েছেন।

কেন শহীদ কন্যাকে এই স্ট্যাটাস দিতে হলো? স্ট্যাটাসের নিচে দেখলাম একটি ছবি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি পলাশ গাছ। এর চারপাশে লোহার বেড়া দেওয়া। একটা সাইন বোর্ডে লেখা ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ চত্বর।’ সেই সাইনবোর্ডটা বিভিন্ন রং দিয়ে এবড়ো-থেবড়ো করে দাগানো। কী লেখা আছে পড়া যাচ্ছে না। এর চেয়েও বড় কথা লোহার বেড়ার দুপাশে তিনটি প্লাস্টিকের ডাস্টবিন ঝুলানো। আর ভয়ের ব্যাপারটা হলো ডাস্টবিন তিনটি শিল্পকলা একাডেমির সৌজন্যে ঝুলানো হয়েছে।

আমি জানি না এই শিল্পকলা একাডেমি থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? শহীদ আলতাফ মাহমুদ চত্বর দেখার পরও কিভাবে এখানে ডাস্টবিন টাঙিয়ে দেওয়া হলো? কারা এখানে চত্বর লেখা নোটিশ বোর্ডে দাগ দিয়ে নষ্ট করলো? তারা নিশ্চয়ই শহীদ আলতাফ মাহমুদকে চেনে না। নাকি চিনেও এই কাজ করলো? কেউ যদি না চেনে, তাহলে তা দোষের হলেও অপরাধ নয়। কিন্তু, এই কাজ যারা ইচ্ছা করে করেছে, তারা অপরাধী।

যে গান আমাদের মন স্পর্শ করে আছে, যে গান শুনে আমরা একুশ উদযাপন করি, সেই গানের সুরস্রষ্টার প্রতি এ কেমন অসম্মান? আমি চিন্তাও করতে পারছি না শাওন মাহমুদের মনে কী অনুভূতি হচ্ছে। তাকে শুধু বলতে চাই, এদেশের অগণিত মানুষ তার বাবার গান গেয়েছে, আর গেয়ে যাবে চিরকাল। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম। মূর্খ ও শয়তান কোন মানুষ যদি তাঁকে খাটো করতে চায়, সে নিজেই খাটো হবে। শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের উচিৎ নিজেদের এই হীন কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।

তাই যখন দেখেছি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ব্যানারে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ব্যানারে এবং আরও দু-একটি ব্যানারে ভাষা শহীদদের ছবির পরিবর্তে বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন আর অবাক হয়নি। আমাদের অনেকের শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানের পরিধি খুবই দুর্বল। এতটাই দুর্বল যে দেশের ইতিহাস বিষয়ে কিছুই জানি না। অনেকেই ঠিকমতো জানে না স্বাধীনতা দিবস কবে এবং কী? বিজয় দিবসই বা কবে, কেন? ভাষা আন্দোলনের শহীদ কারা এবং কেন? ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭৫ এর রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছু জানে না বা যেটুকু জানে, তা খুবই দুর্বল। যারা পড়াশোনা করার সুযোগ পায়নি, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু, যারা পড়াশোনা করেছে, কিংবা কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান— তাদের এই ভুলতো অসহনীয়।

আজকাল আমরা শুধু দিবসগুলো উদযাপন করি কিন্তু গ্রহণ করি না। কোন দিবসের কী তাৎপর্য, তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। দিবস উদযাপন মানে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে মাথায় ফুলের তোড়া দিয়ে ঘুরে বেড়ানো, মোটর সাইকেলের বহর নিয়ে রাস্তায় চ্যাঁচামেচি করা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাল, ডাল, মুরগি, গরু, টেবিল-চেয়ারের উপর একুশ উপলক্ষে ছাড়ের ছড়াছড়ি। সেদিন তো দেখলাম একুশের রাতে আমাদের এলাকায় পটকাবাজিও হলো। একুশের প্রথম প্রহরের সঙ্গে পটকাবাজি, কে বা কারা এই সিস্টেমটা চালু করলো জানি না, তবে অচিরেই এটা সবাই গ্রহণ করবে, আর ভয়টা সেখানেই।

মানুষ উৎসব পালন করবে, দিবস উদযাপন করবে এতে আপত্তিরতো কিছু নেই। বরং আমার ভালো লাগে। আগে মূলত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ এসব পালন করতো। এখন আপামর জনসাধারণ করে। কিন্তু, দুঃখ একটাই এদের অধিকাংশই দিবসের গুরুত্ব না জেনে, অনুধাবন না করে শুধু উৎসব করে যাচ্ছে। আর সে কারণেই উৎসব শেষ হলে সেই পূজার ফুল তারা পায়ে দলে চলে যাচ্ছে। জাতীয় বীরদের অসম্মান করছে। আর আমরা দিনের পর দিন তা সহ্য করে নিচ্ছি।

অথচ এই শহরেই একসময় একুশ আসতো অন্যভাবে— ভোর ৬টার সময় ১০/১৫ জন কিশোর-কিশোরী তাদের কলোনির বড় ভাইবোনদের তত্ত্বাবধানে আসাদগেট থেকে বাসে চেপে, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে, খালি পায়ে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গাইতে গাইতে চলে যেতো আজিমপুর। তারপর খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আজিমপুর গোরস্থানে পৌঁছে যেতো। সেখানে ফুল দিয়ে যেতো শহীদ বেদিতে। সর্বস্তরের মানুষ সাদা-কালো পোশাক পরে সেই বেদিতে শ্রদ্ধা ভরে ফুল নিবেদন করতেন। ফুলের দোকান ছিল না বলে শিশু-কিশোরদের এই দলটি এর-ওর গাছ থেকে কিছু ফুল নিয়ে যেতো— এইভাবেই পার হয়েছে বছরের পর বছর। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় পূর্ণ ছিল এই দিনগুলো কিন্তু ঐশ্বর্য ছিল না।

এরপর সেই কিশোর-কিশোরীরাই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিলো, তখন ছিল এরশাদ সরকারের জমানা। বাতাসে বারুদের গন্ধ। শ্লোগানে-শ্লোগানে মুখরিত আকাশ-বাতাস চারদিক। সেসময় একুশ ছিল আমাদের শক্তি। প্রতিদিনের বইমেলা ছিল আমাদের প্রাণের উৎস। মা-খালাদের কাছে চেয়ে কালো পাড় সাদা শাড়ি পরতাম। ছিল না একুশের পোশাকের আলাদা কোন দোকান বা ব্র্যান্ড। আর থাকলেও এই একুশ উপলক্ষে বাড়তি টাকা খরচ করার কোন রেওয়াজ ছিল না। পুরো বিষয়টাই ছিল মনের।

চাকরিজীবনে একুশের প্রথম প্রহরে আমরা পুরো পরিবার গিয়ে হাজির হতাম শহীদ মিনারে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। মনে হতো আমরা বুঝি সেইসব শহীদের  পরিবারের সদস্য। এরও আগে সেই শিশুকালে বাবা-মায়ের হাত ধরে পৌঁছে যেতাম শহীদ স্বপ্নের কাছাকাছি।

এরপর ক্রমশ কখন যে সময় বদলে গেল বুঝতেই পারলাম না। একদিন লক্ষ্য করলাম আমরা শহীদ বেদি থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছি। সবকিছু ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলো ব্যবসায়ীদের হাতে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি, নববর্ষ, পহেলা ফাল্গুনের আয়োজনে পোশাক-পরিচ্ছদ, মাথায় ফুলের মুকুট, শাল, আনন্দ শোভাযাত্রা, ঢোল, কলসি, যাত্রাপালা, নাটক, মিছিল, মিটিং সব হচ্ছে। এমনকী পটকাও ফুটানো হচ্ছে— শুধু কমে যাচ্ছে মনের যোগটা, আমাদের ভালোবাসাটা। কারো একটা লেখায় পড়েছিলাম, হিন্দি ও উর্দু লেখক কৃষন চন্দরের একটি উদ্ধৃতি, ‘ভালোবাসাটা হচ্ছে একধরনের প্রতিজ্ঞা।’ আর আমাদের সেই ভালোবাসাটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে বলে দেশের প্রতি প্রতিজ্ঞাটাও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Country must be back in business without delay

Amid worker unrest and insecurity in the industrial sector, entrepreneurs and bankers have urged the new administration to focus on rebuilding confidence in the economy.

2h ago