হৃদয় দিয়ে কথার মালা গাঁথলেন আজহারউদ্দিন

ভারতের ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুমে গতকাল সন্ধ্যায় দ্য টেলিগ্রাফ এবং দ্য বেঙ্গল ক্লাব-এর যৌথ আয়োজনে টাইগার পতৌদি স্মারক বক্তৃতা দেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। কানায় কানায় পূর্ণ হলে অন্যান্যদের মধ্যে নবাব মনসুর আলি খান (টাইগার) পতৌদির জীবনসঙ্গিনী শর্মিলা ঠাকুরও ছিলেন। বক্তৃতায় আলোচনা ছিল তার জীবনীভিত্তিক সিনেমা ‘আজহার’ নিয়েও।
Azharuddin-1.jpg
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও শর্মিলা ঠাকুর। ছবি: দ্য টেলিগ্রাফ

ভারতের ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুমে গতকাল সন্ধ্যায় দ্য টেলিগ্রাফ এবং দ্য বেঙ্গল ক্লাব-এর যৌথ আয়োজনে টাইগার পতৌদি স্মারক বক্তৃতা দেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। কানায় কানায় পূর্ণ হলে অন্যান্যদের মধ্যে নবাব মনসুর আলি খান (টাইগার) পতৌদির জীবনসঙ্গিনী শর্মিলা ঠাকুরও ছিলেন। বক্তৃতায় আলোচনা ছিল তার জীবনীভিত্তিক সিনেমা ‘আজহার’ নিয়েও।

ম্যাচ ফিক্সিং, আজীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হওয়া, আদালতের রায়ের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বিয়ে-বিচ্ছেদ, সব মিলিয়ে ক্রিকেটার আজহারউদ্দিনের জীবন উত্থান-পতনে পূর্ণ।

ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক এবং ডানহাতি ব্যাটসম্যান সবার কাছে কবজির মোচড়ে নান্দনিক ব্যাটিংশৈলী উপহার দেওয়ার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। গতকাল আজহার নিজের অন্য এক রূপ সবার সামনে তুলে ধরলেন- তিনি শুধু ক্রিকেটার নন, বক্তা হিসেবেও বেশ পটু।

তিনি যে বক্তা হিসেবে এতটা ভালো তা নিজেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তো আজহার বলেই বসলেন, ‘আমি কখনই জানতাম না যে আমি এত দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতে পারি।’

বক্তৃতার জন্য তার হাতে থাকা স্ক্রিপ্ট দেখিয়ে আজহার বলেন, ‘তারা আমাকে পড়ার জন্য এগুলো দিয়েছেন। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেও যখন তারা আমাকে পড়ার জন্য লিখিত বক্তৃতা দিতেন, তখনও আমি ভয় পেতাম। কথা হৃদয় থেকে বলা ভালো।’

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজহার লিখিত বক্তব্য না পড়ে নিজের মতো করেই কথা বলেছেন। তিনি কথা বলেছেন তার স্মৃতি হাতড়ে, তিনি কথা বলেছেন তার হৃদয় নিংড়ে।

সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান এমএল জয়সিমহার সঙ্গে একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে আজহার বলেন, ‘আমরা যখন ফ্লাইটে উঠলাম, জয়সিমহা স্যার বললেন, তিনি কিছু পান করতে চান। তাই আমি পানি চাই। কিন্তু তিনি পানি নয়, চাইছিলেন টনিক পানি। তখন আমি তাকে বললাম “স্যার, আপনি অনেকক্ষণ ধরে পান করছেন।” তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, “নিজের চরকায় তেল দাও”।’

অন্য আরেকটি ফ্লাইটের গল্প তিনি বলেছেন। ফ্লাইটটি যাচ্ছিল শারজাহতে। আজহারের পাশে তখন ছিলেন টাইগার পতৌদি। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ‘তিনি (মনসুর আলি খান) বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন। আপনারা জানেন, নবাব সাহেব খুবই দয়ালু এবং স্টাইলিস্ট ছিলেন। আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কী বলব, কীভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাই তিনিই আমার দিকে ফিরে বললেন, “চিন্তা করো না, এটা খুবই ছোট একটা ভ্রমণ। মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময় লাগবে। চিন্তা করো না, আমি তোমাকে বেশি কিছু বলার সুযোগ পাব না”।’

টাইগারের সম্পর্কে শর্মিলা ঠাকুরও জানেন না এমন কিছু আজহার প্রকাশ করেছেন, ‘ম্যাডাম, আপনি হয়তো এই ঘটনাটি জানেন না। একবার আমরা সবাই উদয়পুরের একটি বিয়ে থেকে ফিরছিলাম। যখন আমরা নামলাম, তখন আমি নবাব সাহেবকে একপাশে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন তিনি আবার রাজনীতিতে ফিরছেন না। তখন আপনি আমাদের থেকে একটু দূরে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তুমি আমাকে আবার সেই দাল-দালে (কর্দমাক্ত জলাভূমি) টেনে আনার চেষ্টা করছ কেন?”

আজহার নিজে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। কংগ্রেসের হয়ে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদ আসনে জিতলেও ২০১৪ সালে সাওয়াই মাধোপুর আসনে তিনি হেরে যান।

টাইগার পাতৌদির সঙ্গে বনের বাঘের তুলনা করে তিনি বলেন, ‘সে অর্থেও তিনি বাঘই ছিলেন। আপনারা জানেন, তিনি একটু লাজুক ছিলেন, খুব কম কথা বলতেন। জঙ্গলের বাঘও এমনই, খুব কমই দেখা পাওয়া যায়।’

টাইগারের খেলা সরাসরি দেখতে না পারার আফসোস করে আজহার বলেন, ‘আমার জন্মের আগেই তিনি ভারতের কনিষ্ঠতম অধিনায়ক হয়েছিলেন।’

১৯৬৩ সালে হায়দরাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আজহার। বক্তৃতায় তিনি সেখানকার ক্রিকেটের অতীত গল্পও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, হায়দরাবাদের ক্রিকেট ছিল হাস্যকর। এখন সেখানে খেলাটি বেশ শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছে এবং পেশাদার হয়ে উঠেছে। এটা খুবই ভালো। আমরা তখন জিতে বা হেরে মজা করতাম।’

‘একবার, আমি যখন ইংল্যান্ডে কাউন্টি খেলতে গিয়েছিলাম, তখন বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই)-হায়দরাবাদের খেলা চলছিল। বোম্বাই তিন উইকেটে প্রায় ৭৩১ রান সংগ্রহ করে। তখনকার দলীয় অধিনায়ক আরশাদ আইয়ুব বল করছিলেন আর রাজেশ যাদব স্কয়ার লেগে বেশ কয়েকটি বল ছেড়ে দেন। বিরতির সময় যাদবকে আরশাদ বলেছিলেন, “কি করছ, বল ছেড়ে দিচ্ছ!” যাদব বললেন, “আপনি কি বোম্বের স্কোর জানেন?” আরশাদ বললেন, “হ্যাঁ, ৭০০ এর ওপরে। তো?” যাদব বললেন, “এই দুটি বাউন্ডারিতে আর কি-ই বা আসে যায়?”

গেল মাসে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে বাংলাদেশ ও ভারতের যুবাদের মধ্যে ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ে আজহার বলেন, ‘আপনারা জানেন, আজকাল খেলোয়াড়রা সেঞ্চুরি করে বা পাঁচ উইকেট নিয়ে আক্রমণাত্মক উদযাপন করে। যদি আপনি ঠোঁট পড়তে পারেন, তাহলে দেখতে পাবেন তারা কী বলছে। আমি জানি না সেঞ্চুরি করে বা উইকেট নিয়ে ওরা গালাগাল দেয় কেন? তারা খুশি হওয়ার বদলে আপত্তিজনক কথা বলছে। এটা নিয়ে বোর্ডের ভূমিকা রাখা উচিত। আমি যখনই সৌরভের (সৌরভ গাঙ্গুলি) সঙ্গে দেখা করি, তাকে দাদা বলে ডাকি। তার সঙ্গে দেখা করে এসব আমি বলব। কারণ তিনিই এখন বিসিসিআই (ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড) প্রধান।’

ভারতের বর্তমান জাতীয় ক্রিকেট দল নিয়ে মজা করে বেশ কিছু কথা বলেন আজহার। বোর্ডের আরও কিছু জায়গায় কাজ করা দরকার জানিয়ে সাবেক তারকা বলেন, ‘কেন যে দশ-বারো জন করে সাপোর্ট স্টাফ আর সহকারী কোচেরা টিমের সঙ্গে ঘোরে কে জানে! ভারতীয় দলের সঙ্গে তা-ও ঠিক আছে, কিন্তু রাজ্য দলের সঙ্গেও? ব্যাটিং কোচ, বোলিং কোচ, ফিল্ডিং কোচ সব আছে। তা হলে কোচ আবার কী?’

আজহারের কথা শেষ হতে না হতেই অট্টহাসিতে ফেটে পরে পুরো হলরুম।

বক্তব্যের শেষের দিকে আজহার বলেন, ‘রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি একটি জিনিস শিখেছি। তা হলো, আপনি যখন খুব বেশি কথা বলতে শুরু করবেন, তখন আপনি ভুল করতে শুরু করবেন। প্রথম কয়েক মিনিট ঠিক থাকবে, তারপরে কী হবে আপনারা জানেন।’

আজহারের বক্তব্যে মুগ্ধ শর্মিলা ঠাকুর বলেন, ‘সত্যিই আজহার, তুমি যা বলেছ, হৃদয় থেকে বলেছ। টাইগার যে সময় ক্রিকেট খেলত, তখনকার দিনে স্ত্রী বা বান্ধবীদের সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি ছিল না। আমরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কল-বুক করে কথা বলতাম। তা-ও এপাশ থেকে আমি কী বলছি, ও শুনতে পেত না। ওপাশ থেকে ও কী বলছে, আমি কিছু বুঝতাম না।’

Comments

The Daily Star  | English
Dhaka University suspends exams

DU bans all forms of politics on campus

Dhaka University Syndicate tonight decided to ban all forms of partisan politics by teachers, students and staff on the university campus until further notice

7m ago