আনসাং ওমেনদের সম্মাননা

যাদের আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ

ঠাকুরগাঁওয়ের টেপরি রানী। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। ছয় মাস একটি শিবিরে আটকে রেখে চলে নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে প্রাণ নিয়ে ফিরলেও ঘরে তুলতে অস্বীকৃতি জানান তার স্বামী।
‘আনসাং ওমেন: নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ডস ২০২০’ এর বিজয়ী জয়া চাকমা (বামে) পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন (মাঝে), বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক (ডান থেকে পঞ্চম), আইপিডিসির সিইও ও এমডি মমিনুল ইসলাম (ডানে) এবং অন্যান্য পুরষ্কার প্রাপ্তরা। ছবি: স্টার

ঠাকুরগাঁওয়ের টেপরি রানী। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। ছয় মাস একটি শিবিরে আটকে রেখে চলে নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে প্রাণ নিয়ে ফিরলেও ঘরে তুলতে অস্বীকৃতি জানান তার স্বামী।

বাবা-মা চেষ্টা করছিলেন অন্য কোথাও বিয়ে দিতে। তবে বুঝতে পারেন তার গর্ভে সন্তান--এক যুদ্ধ শিশু। শুরু হয় নতুন এক জীবন যুদ্ধ। সন্তানকে নিয়ে একাই থাকার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে ২০১৭ সালে টেপরি রানীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ সরকার।

গতকাল শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টার ও আইপিডিসি ফিনান্সের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘আনসাং ওমেন: নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ডস ২০২০’ পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে টেপরি রানী যখন তার জীবনযুদ্ধের কথা বলছিলেন অডিটোরিয়ামের সবার চোখেই তখন পানি।

টেপরি রানী বলেন,‘ অনেক ব্যথা সহ্য করেছি, অনেক দুঃখ পেয়েছি। আমার মতো কষ্টের মধ্য দিয়ে আর কাউকে যেতে হয়নি।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিভা রানী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশালের বাসা থেকে পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। চলে নির্যাতন।

যুদ্ধের পর বেশ কয়েকবার আবেদন করার পরও আনুষ্ঠানিকভাবে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাননি বিভা রানী।

পুরস্কার নেওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘আমার কিছু বলার ভাষা নেই। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, এখন ২০২০ সাল। অনেক বছর হয়ে গেছে। আমি যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি আনন্দিত এটা চিন্তা করে যে আমাদের ত্যাগের কারণে আজ অনেক মানুষ স্বাধীন।’

অনুষ্ঠানে স্বরচিত একটি ভাটিয়ালি ধারার গান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উত্সর্গ করেন বিভা রানী।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন শারমিন লাকী। এই দুই যোদ্ধার কথা শুনে উপস্থাপনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘মা, আমাদের ক্ষমা করবেন। তবে আনন্দের সংবাদ হচ্ছে আইপিডিসি ফিনান্স এই দুই নারীর যাবতীয় আর্থিক দায়িত্ব নিয়েছে।’

অনন্য দুই নারীকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। প্রত্যেককে দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন আইপিডিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম।

আয়োজনের হসপিটালটি পার্টনার ছিল র‌্যাডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেন।

শারমিন লাকী, তামান্না তিথি, কাজী বুশরা, নাজনীন নাজ, হাবিবা সুলতানা ও শারমিন মৃত্তিকার সমন্বয়ে পঞ্চকন্যার আবৃত্তি দিয়ে শুরু হয় এই সান্ধ্য আয়োজন।

মমিনুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনোনীত ৫০ জনের মধ্য থেকে আমরা ৯ জনকে চূড়ান্ত করেছি। তাদের অবদান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশের যে পরিবর্তন তা বুনেছেন এদেশের নারীরা। আমাদের উন্নয়নের গল্প হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের ৩৫ লাখ নারী শ্রমিকের গল্প, গ্রামের প্রতিটি বাড়ির গল্প।’

‘আনসাং ওমেন' এর জুড়ি বোর্ডের সদস্য ছিলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, মিডিয়াওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারম্যান রোকেয়া আফজাল রহমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু এবং ব্র্যাকের কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ইন্টেগ্রিটি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক আন্না মিনজ।

ক্যাম্পেইনিং ফর পপুলার এডুকেশনের (সিএমপিই) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী ক্রেস্ট এবং দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন লাইলি বেগমের হাতে। দেশের প্রথম লাইসেন্সধারী ইলিশ মাছ আহরণকারী লাইলি বেগম।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুন্নাহার মুন্নিকে সম্মাননা জানানো হয় তার নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে মেয়েদের একটি ফুটবল দল গঠনের জন্য। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন মালেকা বানু।

দলিত সম্প্রদায়ের প্রথম নারী স্নাতক সোনু রানী দাস। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।

আনিসুল হক পুরস্কার তুলে দেন কোহিনুর বেগমের হাতে। সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের জন্য একটি সফল খাদ্য ব্যাংক তৈরি করেছিলেন কোহিনুর বেগম।

কুড়িগ্রামের ছিটমহলে নিজের বাড়িতে একটি গ্রন্থাগার পরিচালনা করেন মমতাজ মহল বেবি। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন রোকেয়া আফজাল রহমান।

এরপর পুরস্কার নিতে আসেন বাংলাদেশের প্রথম নারী ফিফা রেফারি জয়া চাকমা। অ্যাকশন এইডের নির্বাহী পরিচালক ফারাহ কবির তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, মারজিয়া রাব্বানী শশী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি দেশের প্রথম দৃষ্টিহীন নারী আইনজীবী। দুটি কিডনিই বিকল হয়ে অসুস্থ মারজিয়া। অনুষ্ঠানে তার পক্ষ থেকে পুরস্কার নেন তার মা আফরোজা রাব্বানী। পুরস্কার তুলে দেন পারভীন মাহমুদ।

প্রধান অতিথির ভাষণে এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমাকে এই নক্ষত্রদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ দেওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ। তাদের কাছে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। পরিবর্তনের জন্য তাদের অবদান আর দৃঢ় ইচ্ছা আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা যা করছি তা যথেষ্ট নয়। আরও অনেক কিছু করার আছে। তাদের আত্মবিশ্বাস ও নিষ্ঠার কারণে তাদের কেউ থামাতে পারেনি।’

দ্য ডেইলি স্টার  সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমি যখন এই নারীদের দেখি, তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। আমার দেশপ্রেম কতটা? মানবতা কতটা? তাদের তুলনায় তো কিছুই করিনি।’

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

1h ago