ছাত্রলীগের লজ্জা সাবেক নেতা মিলনের ‘হাতুড়ি বাহিনী’

অরুণ ও তার দুই বন্ধু কল্পনাও করতে পারেননি তাদের ভাগ্যে কী আছে! জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঠিকাদারি সংক্রান্ত কাজে তারা বরিশালের নতুন বাজার থেকে ঝালকাঠি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে এসেছিলেন। সেখান থেকে একদল যুবক তাদের তুলে নিয়ে যায়। তাদের রাখা হয় শহরের পূর্ব চাঁদকাঠী এলাকার একটি ভবনের তৃতীয় তলার ঘরে।
Hadisur_Rahman_Milon_Jhalokathi_BCL
ঝালকাঠি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ হাদিসুর রহমান মিলন। ছবি: সংগৃহীত

অরুণ ও তার দুই বন্ধু কল্পনাও করতে পারেননি তাদের ভাগ্যে কী আছে! জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঠিকাদারি সংক্রান্ত কাজে তারা বরিশালের নতুন বাজার থেকে ঝালকাঠি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে এসেছিলেন। সেখান থেকে একদল যুবক তাদের তুলে নিয়ে যায়। তাদের রাখা হয় শহরের পূর্ব চাঁদকাঠী এলাকার একটি ভবনের তৃতীয় তলার ঘরে।

ভবনটির মালিক ঝালকাঠি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ হাদিসুর রহমান মিলন। তার নির্দেশে অরুণ ও তার বন্ধুদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। তাদের অপরাধ ছিল এলজিইডি’র কাজ পাওয়ার পরে তারা মিলনের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তারা চেকবইয়ের ফাঁকা দুটি পাতায় সই দিয়ে মুক্তি পান। তাদের শর্ত দেওয়া হয়, এই ঘটনা কাউকে বলা যাবে না।

কথাগুলো বলছিলেন নির্যাতনের শিকার অরুণ। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, থানায় জিডি করতে যাওয়ার সাহস পাইনি।’

অভিযোগ রয়েছে, অরুণের মতো অনেক ঠিকাদার বিভিন্ন সময় ঝালকাঠিতে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডে এসে মিলন বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নাম গোপন রাখার শর্তে একাধিক ঠিকাদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এসব অফিসে কাজ পেলে প্রথমেই মিলনের সঙ্গে সমঝোতা করতে হতো। অনেক সময় লটারিতে পাওয়া কাজ মিলনকে দিয়ে দিতে হতো।’

এলজিইডি, সওজ, পাউবো ও গণপূর্তের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ এবং শহরে চাঁদাবাজি ও জমি দখল করতে মিলন একটি হাতুড়ি বাহিনী গড়ে তোলেন। এলজিইডিতে একক আধিপত্য ধরে রাখতে সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করেছিলেন মিলন। তার অনুসারীরা লক্ষ্য রাখতেন নতুন ঠিকাদার কিংবা তাদের অপছন্দের কোনো ঠিকাদার এলজিইডি ভবনে প্রবেশ করছে কি না। এই বাহিনী এতটাই দুর্ধর্ষ ছিল যে, তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এলজিইডি’র এক কর্মচারী বলেন, ‘ঠিকাদারি কাজ নিয়ে মিলন নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করতেন। আমরা অসহায় ছিলাম। এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারিনি, কারণ মিলন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এবং তার বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল যারা “হাতুড়ি বাহিনী” নামে পরিচিত। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে হাতুড়িপেটা করা হতো।’

গত ৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে এলজিইডি অফিসে যান ঠিকাদার কামাল হোসেন। অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মিলন ও তার অনুসারীরা তার পথ আটকে জানতে চান— মিলনের অনুমতি ছাড়া কেন এখানে প্রবেশ করেছেন। কামাল হোসেনের কাছে তারা পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। আরও বলেন, এলজিইডি’র কাজ করতে হলে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। কামাল হোসেন চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মিলনের অনুসারীরা তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে জখম করেন। সেই সঙ্গে হুমকি দেন, আবার এলজিইডিতে দেখলে মেরে ফেলা হবে।

কামাল জানান, চিকিৎসার জন্য তিনি হাসপাতালে যেতে পারেননি। গোপনে বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েছেন। ওই ঘটনায় ১৫ জানুয়ারি তিনি মিলন ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ঝালকাঠি থানায় মামলা করেন।

ওই রাতেই পুলিশ মিলনকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় মিলনের বাড়িতে নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র পাওয়া যায়। পরে মিলনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার বাড়ি থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে পুলিশ বাদী হয়ে মিলনের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা দায়ের করে।

এলজিইডি’র হিসাবরক্ষক ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে মারধর করা এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি সদর থানায় আরও একটি মামলা হয়। এর আগে বেশ কয়েকটি অভিযোগে মিলনের বিরুদ্ধে ঝালকাঠি সদর এবং নলছিটিতে ৮টি মামলা ছিল। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ১১টি ফৌজদারি মামলা চলছে।

ঝালকাঠি সদর উপজেলার কিফায়েত গ্রামের বাসিন্দা খালেক ডাকুয়া। বিভিন্ন কাজে তিনি ঢাকায় আসা-যাওয়া করেন। খালেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত ৯ জানুয়ারি আমি ঢাকায় ছিলাম। সে সময় আমার নির্মাণাধীন একটি ভবন দখল করতে আসেন মিলন। তার হাতুড়ি বাহিনী দরজা-জানালার গ্রিল কেটে গাড়িতে করে নিয়ে যান। আমার স্ত্রী বাধা দিতে গেলে মিলনের অনুসারীরা তার মাথায় আঘাত করে জখম করে।’

‘এ ঘটনায় আমার স্ত্রী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করলে তারা আমাদের হুমকি দিতে থাকেন। বলেন, মামলা প্রত্যাহার না করলে তারা আমাকে এবং আমার ছেলে হত্যা করবে। এক পর্যায়ে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে মুচলেকা নেয়— তাদের বিরুদ্ধে আমার স্ত্রীর কোনো অভিযোগ নেই’, বলেন খালেক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘ঝালকাঠির বিনয়কাঠী ডিগ্রি কলেজের কাছেই এক হিন্দু পরিবারের জমি দখলে নিয়ে ইট ভাটা স্থাপন করেছিলেন মিলন।’

মিলন ও তার হাতুড়ি বাহিনীর নির্যাতনের দুটি ভিডিও ডেইলি স্টারের হাতে আসে। যার একটিতে দেখা যায়, ঝালকাঠি এলজিইডি ভবনের সামনে মিলন একজনকে হাতুড়ি দিয়ে মারধর করছেন। অন্য ভিডিওটিতে এলজিইডি অফিসের একটি কক্ষ থেকে একজনকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে। পরে জানা যায়, ওই রুমে বিভিন্ন ফাইল অনুমোদনের জন্য হিসাবরক্ষক কর্মকর্তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

এ প্রসঙ্গে ঝালকাঠি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘মিলনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা ছিল। সেসব মামলায় তিনি জামিনে ছিলেন। এরপরের কেউ লিখিত অভিযোগ না করায় আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। যখন অভিযোগ পেয়েছি, তখনই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

সদর থানা সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ঝালকাঠি মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ডিপো ম্যানেজারের কাছে চাঁদা দাবি করায় মিলনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

মিলন ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঝালকাঠি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মিলন এখন আর সংগঠনের কোনো পদে নেই। হাতুড়ি বাহিনী তৈরি করে তিনি যে কার্যক্রম করেছেন সেটা আসলে দুঃখজনক এবং আমাদের জন্য লজ্জাজনক। আমরা মনে করি, ছাত্রলীগ একটি পবিত্র সংগঠন। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, ছাত্রলীগ যেন মানুষকে সম্মান দিতে শেখে এবং মানুষের পাশে দাঁড়ায়। মিলনের যে কার্যক্রম— টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন জমিও দখল করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থে তিনি ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়েছেন, সুবিধা নিয়েছেন। এ জন্য আমার সংগঠন সাফারার হয়েছে।’

‘এসব অপকর্ম করার পরে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন— আমার কষ্ট লাগে সবাই বলে ছাত্রলীগের সাবেক প্রেসিডেন্ট, ছাত্রলীগের নাম চলে আসে। এটা আমাদের জন্য তিক্ত অভিজ্ঞতা যে, ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি এ ধরনের কার্যক্রম করেছেন। এমনিতেই ছাত্রলীগের বদনামের শেষ নেই। সেখানে আমাদের নতুন করে একটা ঝামেলায় ফেলে দিয়েছেন মিলন। তিনি আমার শত্রু না, মিলন যখন সভাপতি তখন আমি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। কিন্তু তার কার্যক্রমে সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে’, বলেন শফিকুল ইসলাম।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago