লালন স্মরণ উৎসব

উপমহাদেশের কিংবদন্তি বাউল সাধক ফকির লালন শাহের মাজারে গত রোববার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ‘দোল পূর্ণিমা’ উৎসব। উৎসবটির দিন-কাল কারো জানা না থাকলেও জনশ্রুতি আছে যে লালন নিজেই তাঁর জীবদ্দশায় প্রত্যেক পূর্ণ-চন্দ্র তিথিতে এই উৎসব করতেন। এই উৎসবে দুর দূরান্ত থেকে তাঁর শিষ্যরা অংশ নিতেন। সেই থেকেই উৎসবটির চল ও বাউল বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রায় দুইশ বছর হবে এই উৎসবের বয়স। তাঁর শিষ্যরা এই উৎসবকে ‘লালন স্মরণোৎসব’ও বলে থাকেন।
Lalon Utsab
লালন উৎসবে সেজেছে কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়া। ছবি: স্টার

উপমহাদেশের কিংবদন্তি বাউল সাধক ফকির লালন শাহের মাজারে গত রোববার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ‘দোল পূর্ণিমা’ উৎসব। উৎসবটির দিন-কাল কারো জানা না থাকলেও জনশ্রুতি আছে যে লালন নিজেই তাঁর জীবদ্দশায় প্রত্যেক পূর্ণ-চন্দ্র তিথিতে এই উৎসব করতেন। এই উৎসবে দুর দূরান্ত থেকে তাঁর শিষ্যরা অংশ নিতেন। সেই থেকেই উৎসবটির চল ও বাউল বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রায় দুইশ বছর হবে এই উৎসবের বয়স। তাঁর শিষ্যরা এই উৎসবকে ‘লালন স্মরণোৎসব’ও বলে থাকেন।

উৎসবটির কাল পূর্ণ চন্দ্রের দেড় দিন। পূর্ণ তিথির সন্ধ্যালগ্নে ‘রাখল সেবা’র মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল উৎসব। তবে আক্ষরিকার্থে উৎসবটি দেড় দিনের হলেও চলে তিনদিন। এ হিসেবে রোববার সন্ধ্যায় শুরু হয়ে চলবে সোমবার বিকালে ‘অষ্টপ্রহর সাধুসংঘ’ বা ‘পুণ্যসেবা’ গ্রহণ পর্যন্ত।

এদিকে দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে লালনের আখড়াবাড়ি চত্বর এখন উৎসবমুখর। দেশি-বিদেশি অনেক লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটেছে ইতোমধ্যে। তাদের পদচারণয় মুখর এখন বাউল আখড়াটি। অসংখ্য বাউল পূর্ণিমার সন্ধ্যার আগেই লালনের আখড়াবাড়িতে নিজ নিজ আসনে বসেছেন। ‘আসনে’ বসা সাধু-গুরুদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার বিষয়। যার যেমন সামর্থ্য, কেউ সাদা বা রঙিন কাপড়ের টুকরোর ওপর, কিংবা শীতল পাতার মাদুর, এমনকী গামছা বিছিয়েও আসনে বসে থাকেন।

প্রতি সন্ধ্যাতেই স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা যাতে অংশ নেন লালন বিশেষজ্ঞসহ অনেকে আর তারপরই রাতভর চলে লালনের গান। বসেছে জমজমাট লোকশিল্প মেলা। তিনদিনের এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন প্রায় কয়েক লক্ষাধিক মানুষ।

বাউল সংগীতে লালনের সমকক্ষ কেউ নেই। তাঁর গানেও বিকল্প কোনো নাম পাওয়া যায় না। গানই ছিল তাঁর দর্শন। এই গানের মধ্য দিয়েই তিনি সাধক, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক। এই গানের মধ্য দিয়ে কেবল আধ্যাত্ম দর্শনই নয়, বাংলার সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের কথাও প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ প্রভৃতি নামে অভিহিত।

লালনের আধ্যাত্ম চেতনা ছিল ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব প্রকার জাতিগত বিভেদের ঊর্ধ্বে। সেখানে ছিল মানবপ্রেম ও মানবতা। যার মুল সুর ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। তিনি নিজেও তার জাত-ধর্ম সম্পর্কে নিঃস্পৃহ ও উদাসীন ছিলেন। তিনি কখনও এ বিষয়ে নিজে কিছু বলেননি। লালনের জীবনকাহিনী অনেকাংশেই রহস্যাবৃত। তাঁর মৃত্যুর পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত অমর কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক ‘হিতকরী পত্রিকা’র সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ‘ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না। তথাপি কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতিরেকেই একটি সূত্রে তাকে হিন্দু কায়স্থ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও লালন হিন্দু না মুসলমান এই কৌতূহল ও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে জীবদ্দশায়।”

লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।

লালন কুষ্টিয়া শহরের কালীগঙ্গা নদীর তীরে ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে বাংলা ১৮২৩ সাল মতান্তরে ১৮৩০ সাল নাগাদ আখড়া স্থাপন করেন। অল্পদিনের মধ্যেই লালনের প্রভাব ও পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জীবদ্দশায় লালনের একটি স্কেচ তৈরি করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তার বোটে বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন। যা ভারতীয় জাদুঘরের সংরক্ষিত আছে। যদিও কেউ কেউ দাবি করেন, স্কেচটিতে লালনের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি।

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে লালন শাহ দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিষ্য-ভক্ত পরিবেষ্টিত থেকে গানবাজনা করেন। এরপর ভক্ত-শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি চলিলাম’। লালনের ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোন ধর্মীয় রীতিই পালন করা হয়নি। তারই ইচ্ছে অনুসারে আখড়ার একটি ঘরের ভেতর তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

মৃত্যুর ১২ দিন পর হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত এক রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে ‘মহাত্মা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। লালন আজ নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি। যার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন বাঙালির মরমী মানসপটে।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে তিনদিনব্যাপী এ স্মরণোৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি। অনুষ্ঠানে অতিথি থাকছেন আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান এমপি, সেলিম আলতাফ জর্জ এমপি, কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত প্রমুখ।

কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত জানিয়েছেন, উৎসবকে কেন্দ্র করে এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য।

Comments