করোনাভাইরাস

বিমানবন্দরের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা এখনো ঢিলেঢালা

যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার থেকে গতকাল সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে একটি উড়োজাহাজ এসে নামল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
airport
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুপুর আড়াইটার দিকে নির্জন ইমিগ্রেশন বুথ। ১০০টিরও বেশি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বিমানবন্দরে আসা যাওয়া করা যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে। ৯ মার্চ ২০২০। ছবি: রাশেদ সুমন

যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার থেকে গতকাল সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে একটি উড়োজাহাজ এসে নামল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ওই উড়োজাহাজের যাত্রীরা নামার পর যাচ্ছিলেন বিমানবন্দরের হেলথ ডেস্কের দিকে। থার্মাল স্ক্যানারের পাশে দাঁড়ানো কর্মকর্তারা যখন তাদের কাছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পূরণ করা ফরম চান তখন যাত্রীদের একটু বিস্মিত হতে দেখা যায়।

যাত্রীরা জানান, উড়োজাহাজে তাদের এধরনের কোনো ফরম দেওয়া হয়নি। এমনকী, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কেও তাদের জানানো হয়নি।

কর্মকর্তারা যে পূরণ করা ফরমটি চাচ্ছিলেন তার মাধ্যমে যাত্রীদের সাম্প্রতিক ভ্রমণ ইতিহাস ও জ্বর, শ্বাসকষ্ট, বমিভাব, মাথা ব্যথা বা কাশি আছে কিনা সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব এয়ারলাইনসকে নির্দেশনা দিয়েছে এই ফরমগুলো যাত্রীদের কাছে সরবরাহ করতে এবং তা পূরণ করার পর হেলথ ডেস্কে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিতে।

ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি শহর ম্যানচেস্টার। রোববার পর্যন্ত এই শহরে পাঁচ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ নিশ্চিত করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।

কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা স্পাইসজেটের উড়োজাহাজটিও বাংলাদেশ বিমানের কাছাকাছি সময়েই পৌঁছে। বিমানবন্দরের হেলথ ডেস্কে প্রায় একই সময়ে পৌঁছে যান ফ্লাইট দুটির যাত্রীরা।

যাত্রীরা যখন থার্মাল স্ক্যানার আর্চওয়ে পার হচ্ছিলেন তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা হাত দিয়ে ব্যবহার করতে হয় এমন একটি ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করছিলেন। আরও চার কর্মকর্তাকে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল যাত্রীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ফরমটি সরবরাহ করতে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সহকারী স্বাস্থ্য পরিচালক জহিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যাত্রীরা যদি হেলথ কার্ডটি পেয়ে না থাকেন আমরা তা সরবরাহ করছি।’

তিনি যখন কথা বলছিলেন তখন অনেক যাত্রীকেই দেখা গেল পূরণ করা ফরম জমা না দিয়েই চলে যেতে।

একই সঙ্গে প্রায় ৫০ যাত্রী ডেস্কের সামনে এসে পৌঁছলে স্পষ্টতই দেখা যায় সেখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সুশৃঙ্খলভাবে স্ক্রিনিং করতে পারছেন না।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সবারই মুখে মাস্ক পড়া ছিল। তবে নিরাপত্তার জন্য ডিসপোজেবল অ্যাপ্রোন পড়েছিলেন কেবলমাত্র একজন এবং গ্লাভস পড়েছিলেন দুজন।

এ বিষয়ে ভাইরোলজিস্টদের সঙ্গে আলোচনা করলে তারা জানান, বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ব্যবহার করা স্বাস্থ্য উপকরণগুলো করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ করতে যথেষ্ট ছিল না। তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তারা আক্রান্ত হলে ভাইরাসটি অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘গুরুতর পরিস্থিতিতে আমরা বিশেষ পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) পড়ি। আমাদের কাছে এগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই।’

হেলথ ডেস্কে ছোট্ট একটি বোতলে রয়েছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যাত্রীদের কাউকেই স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা বিমানবন্দরে অবস্থানকালে সেখানে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে এমন কোনো কার্যক্রম দেখতে পাইনি। বিমানবন্দর সূত্র থেকে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

শুধুমাত্র চীন ছাড়া অন্য দেশ থেকে আসা যাত্রীদের একই অভিবাসন বুথ ব্যবহার করতে দেখা যায়।

airport
সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য উড়োজাহাজের টিকিট কিনতে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেল চত্বরে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। বেশিরভাগই জানান, তারা ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। তবে যত শিগগির সম্ভব ফিরে যেতে চান। কারণ, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশটি যে কোনো সময় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। ৯ মার্চ ২০২০। ছবি: আনিসুর রহমান

এখন পর্যন্ত নবেল করোনাভাইরাসটি ১০০টির বেশি দেশে এক লাখ ১৩ হাজার ৩৫৮ জনকে সংক্রমিত করেছে। তাদের মধ্যে মারা গেছেন চার হাজার নয় জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৬৩ হাজার ৯১৩জন।

এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে চীনে। চীনের পরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে ইতালি। দেশটিতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে নয় হাজার ১৭২ জন এবং মারা গেছেন ৪৬৩ জন।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে তিন জন আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। তিন জনের মধ্যে দুজন সম্প্রতি ইতালি থেকে ফিরেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে নভেল করোনাভাইরাস কোভিড -১৯ গত বছর ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত করা হয়। ভাইরাসটি কোনো প্রকার লক্ষণ প্রকাশ না করে ১৪ দিন পর্যন্ত মানবদেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।

বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও বিশ্বের কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ বিমানবন্দরকে এর উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ইতালি থেকে আসা সব যাত্রীদের জন্য তারা একটি নির্দিষ্ট গেট ব্যবহার করছে।

আরেকটি উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পরই তারা সতর্ক হয়ে যায়। বিমানবন্দরে আসা যাওয়া করা এয়ারলাইনের ক্রুদের বিশেষ নিরাপত্তা পোশাক দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিটি বিমানকে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

ঢাকা বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের শিথিলতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে কোনো ছোটখাটো ফাঁকফোকরই ভয়ংকর পরিনতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেসব দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ইতোমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে সেসব দেশ থেকে আসা যাত্রীদের অন্য যাত্রীদের থেকে আলাদা করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন তারা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক মোজাহেরুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্ক্রিনিংয়ের প্রক্রিয়াটি জোরদার হওয়া উচিত। কোনোভাবে নজর এড়িয়ে গেলেই তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘বেশি আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের আলাদাভাবে স্ক্রিনিং করা উচিত। সেই সঙ্গে উড়োজাহাজ ও যাত্রীদের লাগেজগুলোও জীবাণুমুক্ত করা দরকার। তা না হলে শুধু স্ক্রিনিংয়ে কাজ হবে না।’

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশি ভিসা সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমরা শুরু থেকেই এই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলাম।’

মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও মতামত নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

13h ago