সদা জাগ্রত নিউইয়র্ক এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন
চীনে কয়েক হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে করোনাভাইরাস এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে ভয়ঙ্কর থাবা বাড়িয়েছে। করোনার বিস্তাররোধে বিলম্বে হলেও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন রাজ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করে করোনা এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় সব কয়েকটি রাজ্যে।
খুব দ্রুত করোনা নিয়ে পরিসংখ্যান পাল্টে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৫ হাজার ৭০০। নিউইয়র্কে আক্রান্ত ৪৬৩ ও মৃতের সংখ্যা ১৩। সেখানে এখন পর্যন্ত সাত বাংলাদেশির আক্রান্ত হওয়ার সংবাদে উদ্বেগ বেড়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের কোভিড-১৯ রেসপন্স টিমের সমীক্ষার বরাত দিয়ে নিউজ পোর্টালগুলো জানাচ্ছে, করোনা প্রতিরোধ করা না গেলে যুক্তরাষ্ট্রে এই রোগে ২২ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
গত ৭ মার্চ নিউইয়র্ক রাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিশ্ব মহামারি ও ১৩ মার্চ দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পথ ধরেই জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে।
এর আগে ১২ মার্চ সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক ও স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অধীনে থাকা সব কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০ মার্চ থেকে এই কলেজগুলোতে শুরু হবে অনলাইন ক্লাস। এখন শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রতিনিয়তই চলছে এ নিয়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা।
এদিকে, ১৬ মার্চ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত এলেমেন্টারি স্কুল, মিডল স্কুল ও হাইস্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুল বন্ধের এই ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলেন অনেকই। কিন্তু, নিউইয়র্কের মেয়র ও গভর্নর স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিতে কিছুটা দেরি করেছেন। নিউইয়র্কের স্কুলগুলোতে সকালে ও দুপুরে দুবেলা খাবার সরবরাহ করা হয়। অনেক শিক্ষার্থী এই খাবারের উপর নির্ভরশীল। হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ করে দিলে এই শিক্ষার্থীরা খাবারের সঙ্কটে পড়বে এই আশঙ্কায় এতদিন স্কুল বন্ধ করা হয়নি।
অবশেষে স্কুল বন্ধের ঘোষণা আসলেও স্কুল থেকেই আগামী সাতদিন খাবার সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। স্কুল বন্ধ হলেও শিক্ষকদের মধ্যে ১৭ মার্চ থেকে স্কুলে শুরু হচ্ছে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি। কোন পদ্ধতিতে এই অনলাইন ক্লাসগুলো নেওয়া হবে, কোন পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি উপযোগী, কোন পদ্ধতি হলে সহজলভ্য ডিভাইসের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করা যাবে— এসব নিয়ে সব প্রতিষ্ঠানেই চলছে আলোচনা, বিশ্লেষণ।
করোনা বিপর্যয়ের মাঝেও শিক্ষাব্যবস্থাকে চালু রাখার ব্যাপারে আমেরিকার সরকার খুবই সচেতন। আমেরিকাতে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অনলাইন কার্যক্রম অনেক আগে থেকেই চালু আছে। অনেক বড় বড় পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বিষয়ের সঙ্গেই রয়েছে কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিটি। যেমন হোমওয়ার্ক, প্রজেক্ট, প্র্যাকটিস এক্সারসাইজ— এরকম অনেক কিছুই বেশ আগে থেকেই চালু আছে। কাজেই অনলাইন ক্লাস চালু করতে আমেরিকার খুব একটা অসুবিধা হবে না। তবে কিছু প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস, যেগুলো ক্লাসরুম ছাড়া নেওয়া যায় না সেগুলো নিয়ে আপাতত সমস্যা রয়ে যাচ্ছে।
অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট জড়িত। ইতোমধ্যে অনেক ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যেসব ছাত্রদের ইন্টারনেট কানেকশন নেই তাদেরকে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট সংযোগের আশ্বাস দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষক, কর্মচারী আপাতত বেকার হয়ে যাচ্ছেন। এসব বেকারদের জন্য রয়েছে আনইমপ্লয়মেন্ট অথবা করোনাভাইরাস বেনিফিট প্রাপ্তির ব্যবস্থা। যাতে করে তারা অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে না যান।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকাই বলা যায়। গণপরিবহন মানে সাবওয়ে কিংবা বাসে ভিড় নেই বললেই চলে। রাস্তা ফাঁকা, গণপরিবহন ফাঁকা। ভাবতে অবাক লাগে শহরের যে জায়গাগুলোতে প্রতিমুহূর্তে মানুষের ভিড় লেগে থাকে সেই জায়গাগুলো এখন প্রায় জনমানব শূন্য। ট্যাক্সির বহর নেই। নিউইয়র্কে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়ানোর প্রথমদিকে সামর্থ্যবানদের অনেকেই পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পরিবর্তে লিফট, উবার কিংবা ক্যাবের যাত্রী হতে শুরু করেন। তখন লিফট, উবার ও ক্যাবের ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু, স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়ায়, এবং সেই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর এই সেক্টরে ব্যাপক মন্দাভাব বিরাজ করছে।
মানুষের যাতায়াত সীমিত হওয়ার কারণে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে ব্যাপকহারে। রাস্তায় যদি মানুষই না থাকে একা একা গাড়ি ঘুরে কী করবে? বিশেষ করে যারা ইয়েলো ক্যাব ভাড়ায় চালান তাদের জন্য সমস্যাটা বেশি। যাত্রী পাওয়া যাক কিংবা না যাক ভাড়ার টাকা তো দিতে হবে।
প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বারবার। কারণ মানুষ যত চলাফেরা করবে, তত ভিড় বাড়বে, করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকিও বাড়বে। তাই ঝুঁকি কমাতে ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে ‘অবরুদ্ধকরণ’। নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি ও কানেকটিকাট— এই তিন রাজ্যে একসঙ্গে অবরুদ্ধকরণ শুরু হয়েছে। যার ফলে রাত আটটার পর রেস্টুরেন্ট, বার, ক্যাফে বন্ধ থাকবে। এসব জায়গায় বসে কোনোরকম খাবার গ্রহণ করা যাবে না। তবে অর্ডার করে খাবার নিয়ে যাওয়া যাবে। যে কারণে আজকে অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে ক্যাফে কিংবা বারে চেয়ার টেবিল দেখা যায়নি। যারা চেয়ার-টেবিল সরাতে পারেনি তারা চেয়ারগুলোকে টেবিলের উপর উপুড় করে রেখে দিয়েছেন। যার মানে হচ্ছে বসার ব্যবস্থা নেই। অবরুদ্ধের এর কারণে বন্ধ সিনেমা হল, থিয়েটার, পার্টি হল ও অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রগুলো।
গ্রোসারিগুলোর র্যাক অনেকটাই ফাঁকা। লোকজন অধিকাংশ খাদ্য সামগ্রী কিনে নিয়ে চলে গেছে। গ্রোসারি শপের র্যাকগুলোকে খাদ্যসামগ্রীর এতটা সঙ্কটে পড়তে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। আর স্যানিটাইজার আর মাস্ক? সে তো কবে থেকেই উধাও। দু-একটা দোকানে যাও এগুলোর দেখা মেলে কিন্তু দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও গভর্নরের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, কেউ যদি কোনো জিনিসের দাম এই অবস্থায় বেশি রাখে তাহলে তার বিরুদ্ধে ফোন করে অভিযোগ জানান এবং ক্রয় রশিদ সংরক্ষণ করুন। এতে কাজ কিছুটা যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। ইতোমধ্যে বেশকিছু দোকানে পুলিশ অভিযোগের ভিত্তিতে তৎপরতা চালিয়ে জরিমানা করেছে। অবরুদ্ধের আওতায় ১০ জনের বেশি লোককে একসঙ্গে চলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অবরুদ্ধের এই আইন অমান্য করলে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে বলেও জানানো হয়েছে।
করোনা সংক্রমণের কারণে যুক্তিসঙ্গতভাবে আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যারা বেকার হয়ে পড়েছেন, সবার আলোচনার বিষয় আনএমপ্লয়মেন্ট ও করোনাভাইরাস বেনিফিট। কারণ এটি না পেলে তাদের অনেকেরই সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
একদিকে করোনা সংক্রমিত হওয়ার আতঙ্ক অন্যদিকে এই রোগ থেকে বাঁচতে গিয়ে নেমে আসা আর্থিক বিপর্যয়, সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করে তুলছে। এরকম বিপর্যস্ত পরিস্থিতির কথা যে সরকার জানে না তা নয়। এর থেকে উত্তরণের জন্য বেশকিছু উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। যার মধ্যে রয়েছে স্বল্পসুদে কিংবা বিনা সুদে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল দিতে অসমর্থ হলে সে ক্ষেত্রে কিস্তির মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের সুযোগ করে দেওয়া। এ ব্যাপারে নিউইয়র্কের বৃহৎ বিদ্যুৎ পরিবেশনকারী সংস্থা- কনেড ইতোমধ্যে তাদের গ্রাহকদের ইমেইল ও টেক্সটের মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত করেছে।
চিকিৎসার ব্যাপারেও দেওয়া হয়েছে নানা রকম দিক নির্দেশনা। কেউ সামান্য মাত্রায় অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। ছোটখাটো সমস্যার জন্য প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ানকে ফোন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ রোগীর ভিড় কমিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সহজলভ্য করা। তারপরও কোনো রোগী যদি ইমারজেন্সিতে চলে যান তাকে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। কিছু প্রশ্ন করার মাধ্যমে চলছে এই স্ক্রিনিং পদ্ধতি। এভাবে কোনো কোনো রোগীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেলফ কোয়ারেন্টিনের জন্য। যাদের নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে, রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে তাকে ভর্তিও করা হচ্ছে হাসপাতালে।
সিটি মেয়র, গভর্নর ভীষণ ব্যস্ত। প্রতিমুহূর্তে খোঁজখবর করছেন। দিনে অন্তত দুই বার করে বিবৃতি দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করছেন, রক্ষা পাওয়ার উপায়গুলো অবহিত করছেন, সাহস যোগাচ্ছেন এই দুর্যোগ মোকাবেলার।
যাদের সময় আছে, অর্থসঙ্কটের আশঙ্কা নেই তারা বাসায় করোনা আতঙ্কের শতরঞ্জিতে বসে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন মুভি দেখছেন।
নিউইয়র্ক শহরে অনেক পার্ক আছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে অনেক মানুষ এই পার্কে একটু সময় কাটাতে আসেন। স্কুলের পার্কে থাকে শিশু-কিশোরদের মুখরিত উপস্থিতি। সিটি পার্ক, স্কুলের পার্ক সব যেন বিরান ভূমি।
ছোট-বড় সবাই এখন গৃহবন্দি। দরকার ছাড়া কেউ আর ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে না। অচেনা অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে ভীত। সবার চোখ টিভি চ্যানেলের দিকে, ফেসবুকে, ইউটিউবে, যদি কোনো কার্যকর উপায় পাওয়া যায় করোনা থেকে রেহাই পাওয়ার।
যে শহর কখনো ঘুমায় না, সদা জাগ্রত সেই নিউইয়র্ক এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। চিনতে খুব কষ্ট হয় শহরের ব্যস্ততম সড়ক, দর্শনীয় স্থান, রেস্টুরেন্ট ও বিনোদনকেন্দ্রগুলোকে।
অন্তত আরও দুই সপ্তাহ নিউইয়র্কের এই নিস্তব্ধতা বজায় থাকবে। ততদিনে করোনা পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায় কে জানে! এভাবে চলতে থাকলে ব্যক্তি পর্যায়ের আর্থিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। একদিকে মহামারি, মৃত্যুঝুঁকি অন্যদিকে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়ার কষ্ট মানুষকে যে কতটা অমানুষ করে তুলতে পারে, মানুষকে যে কতটা দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তা ‘কন্টাজিয়ন’ ও ‘ফ্লু’— এই দুটি মুভি দেখে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যায়। মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষীণ এই আশঙ্কা যেন কোনোভাবেই অঙ্কুরিত না হয় সেটাই প্রার্থনা।
সজল আশফাক: লেখক-চিকিৎসক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Comments