লকডাউন? নাকি লুকআউট?

লেখক সাখাওয়াত টিপুর সঙ্গে আমি একমত হলাম। ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটাকে মানুষ ভয় পায়। যে শব্দটা মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে, সেই শব্দ দিয়ে মানুষের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ (কমিউনিকেট) করবেন কীভাবে? মানুষকে কোনো কিছুর জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন কীভাবে?
Shibchar
করোনার বিস্তার রোধে ‘বিশেষ নজরদারিতে’ আনা মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার চারটি এলাকায় দোকানপাট বন্ধ। ছবি: স্টার

লেখক সাখাওয়াত টিপুর সঙ্গে আমি একমত হলাম। ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটাকে মানুষ ভয় পায়। যে শব্দটা মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে, সেই শব্দ দিয়ে মানুষের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ (কমিউনিকেট) করবেন কীভাবে? মানুষকে কোনো কিছুর জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন কীভাবে?

সাখাওয়াত টিপু ঢাকার বাস্তব ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘এইখানে (বাংলাদেশে) এমন শব্দ ব্যবহার করলে মানুষ/রোগী ভয় পেয়ে যায়। দুই/তিন পত্রিকায় নিউজ দেখলাম, কোয়ারেন্টিনের ভয়ে রোগী পালিয়ে গেছে!’

‘করোনাভাইরাসের লক্ষণ আছে’ জানার পর ঢাকার কোনো একটি হাসপাতাল থেকে রোগী পালিয়ে গেছে— এমন একটি সংবাদ পত্রিকায় পড়েছিলাম। অনেকবার ভেবেছি, অসুস্থতার খবর জানার পর চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগী পালাবে কেনো? সাখাওয়াতের ব্যাখ্যানুসারে রোগী পালিয়েছে আতঙ্কে।

লেখকদের অন্তর্দৃষ্টি থাকে, তাই সাখাওয়াত বিষয়টি এভাবে দেখেছেন। তবে ফেসবুকে এ নিয়ে ট্রল হতে দেখেছি। সমালোচনা হতে দেখেছি। কেউ এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেননি। কোনো পত্রিকাও এ নিয়ে আর ফলোআপ করেনি।

অথচ আমরা সারাদিনই ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘কোয়ারেন্টিন’ বলে গলা ফাটাচ্ছি। পত্রিকা, টেলিভিশন, ফেসবুক সর্বত্রই কোয়ারেন্টিন নিয়ে আলোচনা। ‘কোয়ারেন্টিন’ এ না থাকলে জেল-জরিমানার হুমকিও দিচ্ছেন আমাদের মন্ত্রীরা। কোথাও কোথাও জরিমানা করার পুলিশি তৎপরতার কথাও শুনেছি। একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে ‘প্রবাসী’ শব্দটিও।

পত্রপত্রিকা পড়ে সাধারণভাবে যে কারো ধারণা হবে— বাংলাদেশে ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটি তৈরি হয়েছে কেবলমাত্র প্রবাসীদের জন্য। শুনেছি, ঢাকার চিকিৎসকদের একটি বড় দল ইন্দোনেশিয়ার বালিতে একটি কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশর সঙ্গে শিশুও ছিল। প্রায় এক সপ্তাহ সেখানে কনফারেন্স/ ভ্যাকেশন কাটিয়ে দলটি দেশে ফেরে। তাদের অধিকাংশই সেলফ কোয়ারেন্টিনে যাননি। তাদের নিয়ে কিন্তু কোথাও কোনো সংবাদ হয়নি, কোনো সমালোচনাও নেই।

প্রবাসীদের কেউ কেউ দেশে এসেই এখানে-সেখানে চলে যাচ্ছেন, বাজারে-বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বিয়ে-শাদি করছেন— এমন সংবাদ আমরা পত্রপত্রিকায় পাই। এগুলো অন্যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত। তাদের সমালোচনা করে কেউ কেউ বলেছেন, বিদেশে থেকেও এরা সচেতনতা শিখেননি। দেশে আসা প্রবাসীদের সম্পর্কে বৈরী মনোভাব তৈরি হয়েছে।

শুনেছি শিবচরে যে ‘লকডাউন’ হয়েছে তার কারণও নাকি প্রবাসীরা। ওই অঞ্চলে নাকি প্রচুর সংখ্যক প্রবাসীর বাস, যারা সম্প্রতি দেশে এসেছেন। কোনো এক মন্ত্রী নাকি বলেছেন, যেসব এলাকায় বেশি প্রবাসী আছেন, সেই সব জেলায় ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রবাসীদের অবস্থানটা যে কতোটা নাজুক ও অনিরাপদ— এসব তথ্য থেকে আন্দাজ করা যায়।

করোনায় আক্রান্ত বিভিন্ন দেশ যখন তাদের দেশে বিদেশিদের প্রবেশ সীমিত করতে ‘লক ডাউন’ ঘোষণা করছে, বাংলাদেশ তখন নিজ দেশের প্রবাসীদের, যারা সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছে, তাদের এলাকায় অবরুদ্ধ রাখতে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করছে। বিষয়টায় স্বাতন্ত্র্য আছে অবশ্যই।

বাংলাদেশে অবস্থানরত কয়েকজন প্রবাসীর আচরণ নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে নিজেও স্তম্ভিত হয়েছি। ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুরা এদের আচার-আচরণ নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। এই প্রবাসীরা আসলে কারা? বিশ্বব্যাপী এমন অনিশ্চয়তা তাদের একটুও স্পর্শ করছে না কেনো? বাংলাদেশকে তারা এতোটাই নিরাপদ ভাবছেনই-বা কিভাবে? করোনা নিয়ে তাদের মনে সামান্যও উদ্বেগ নেই কেনো?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা শ্রমিকদের সম্পর্কে আমাদের খানিক ধারণা আছে। এরা কি তা হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে যাওয়া সেই সব শ্রমিকরাই? যাদের দেশে সেই অর্থে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, জীবনে সংস্কৃতির স্পর্শ ছিল না। যারা বিদেশে গিয়েও নিতান্তই ‘লেবার’ হিসেবে কেবল পয়সা কামিয়ে দেশে পাঠিয়েছেন! ইতালি থেকে আসা মানুষগুলো কি তাদের থেকে ব্যতিক্রম?

গত কয়েক বছর ধরেই ইতালি অর্থনৈতিকভাবে চাপের মধ্যে আছে। শিক্ষিত বাংলাদেশিদের অনেকেই ইতালি ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে থিতু হয়েছে। ইতালি ছাড়তে চান এমন অনেকের সঙ্গেই বিভিন্ন সময় টেলিফোনে কথা হয়েছে। ইতালিতে থাকা বাংলাদেশিদের বড় একটা অংশই মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের মতো, নানা উপায়ে ইউরোপে ঢুকে ইতালিতে বসবাস শুরু করেছেন। ইতালিতে থাকলেও পেশাগত অবস্থান ও আর্থিক কারণে ইতালির মূল সংস্কৃতির সঙ্গে তারা তেমন কোনো যোগসূত্র স্থাপন করতে পারেননি। ফলে অনেক বছর ইতালিতে বসবাস করেও চেতনাগত দিক থেকে তারা সেই গ্রামের স্বল্প কিংবা অশিক্ষিত মানুষটিই রয়ে গেছেন।

শুনেছি অর্থনৈতিক কারণে টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন। এদের মধ্যে কি তারাও আছেন? এদের শিক্ষা, সংস্কৃতির মান আসলে কোন পর্যায়ে? ইতালি থেকে যে তরুণ বিমানবন্দরে নেমে চিৎকার করে বলেছেন, ‘আমরা শুকর খাই না, আমাদের করোনা হবে না, যারা ব্যাঙ, শুকর খায় তাদের করোনা হয় বাংলাদেশের মানুষ সেটা জানে না’— সেই তরুণকে ‘কোয়ারেন্টিন’ বোঝাবেন কিভাবে? তার কাছে কোয়ারেন্টিন তো অজানা কোনো শাস্তির নাম।

করোনা আক্রান্ত কানাডা তাদের নাগরিকদের ঘরে থাকতে বলেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সহজ ভাষায় বলেছেন, ‘স্টে হোম’, অর্থাৎ বাড়িতে  থাকো। কানাডা প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং’ বা সামাজিক দূরত্বে থাকা দরকার। কানাডার মিডিয়া এই শব্দগুলোই ব্যবহার করেছে। এই দুটি শব্দই সহজে বোঝা যায়, কোনো আতঙ্ক তৈরি করে না। বরং এক ধরনের আশ্রয়ের ইঙ্গিত দেয়। কেনো এটা করতে হবে সেটি তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। মানুষ সহজেই বুঝতে পেরেছে সরকার কি করতে বলছে, কেনো করতে বলছে। তারা তাতে সায় দিয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটা নতুন। কেউ তাদের সহজ করে বুঝিয়ে দেয়নি এর মানে কী, কেনো এটি দরকার। বিষয়টা বুঝে ওঠার আগেই যখন ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘কোয়ারেন্টিন’ বলে চারদিকে শব্দ উঠেছে, তখন তারা আতঙ্কিত হয়েছেন। প্রবাসীদেরও এমনটি হয়েছেন বলে আমার ধারণা।

কাউকে দিয়ে কিছু করাতে হলে তাকে কেবল নির্দেশ দিলেই হয় না, তাকে তথ্য দিতে হয়, তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়— তার মধ্যে মোটিভেশন তৈরি করতে হয়। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে কঠিন ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দ ব্যবহার করেই উদ্বুদ্ধ করে ফেলার আশা আমরা কিভাবে করি।

তাছাড়া ঘরে বসে থাকার সঙ্গে তো রুটি-রোজগারের প্রশ্নও জড়িত। সেই ব্যাপারেও তথ্য থাকতে হবে। করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে যখন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিত  তথ্য সরবরাহ করেন, কি হচ্ছে, সরকার কি করছে, সরকার নাগরিকদের কাছে কি চায় সেগুলো তুলে ধরছে, আমরা তখন ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘কোয়ারেন্টিন’ করছি, যার অর্থটাই সিংহভাগ মানুষের অজানা। এর মাঝেই, কারা যেন দেশে জরুরি অবস্থা জারির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন, কেউ কেউ লকডাউনের দাবি জানাচ্ছেন। ধারণা করি, করোনা আক্রান্ত অন্যান্য দেশের উদ্যোগের এই অংশগুলো তাদের পছন্দ হয়েছে।

করোনা অবশ্যই বৈশ্বিক সংকট। কিন্তু এর মোকাবেলার ধরনটা দেশভেদে ভিন্ন হচ্ছে। কেবল ‘লকডাউন’ই এর সমাধান নয়— ‘লুকআউট’ও গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে আমাদের ‘লুকআউট’ কী হবে— সবার আগে সেটা নির্ধারণ করা জরুরি।

শওগাত আলী সাগর, কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’র প্রধান সম্পাদক

Comments

The Daily Star  | English

Mob beating at DU: Six students confess involvement

Six students of Dhaka University, who were arrested in connection with killing of 35-year-old Tofazzal Hossain inside their hall on Wednesday, confessed to their involvement in the crime before a magistrate

3h ago