৫ শতাংশ ভোটের ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’!
আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের মতে গণতন্ত্র হলো ‘জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার’ (government by the people, for the people, of the people)। এটাকেই গণতন্ত্রের সর্বজনীন, সর্বাধিক সমর্থিত ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদি এটাকেই গ্রহণযোগ্য ধরা হয় তাহলে শনিবারের ঢাকা-১০ এর উপনির্বাচনকে গণতান্ত্রিক বলার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। কারণ, এখানে সবই ছিল, শুধু ভোটারের উপস্থিতি ছাড়া।
ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারি ফলাফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জয়ী হয়েছেন ১৫ হাজার ৯৯৫ ভোট পেয়ে। এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৫ হলেও ভোট পড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ যা নিকট অতীতে সর্বনিম্ন।
সংসদ নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, কোনো আসনের নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম ভোট পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্তের বিধান আছে। কিন্তু, একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ ভোট পেলে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী?— এটা যেহেতু নির্বাচনী আইনে নেই, সুতরাং তাকে বিজয়ী ঘোষণা করার ব্যাপারে আইনি কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু, একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে তিনি কি জনপ্রতিনিধি?
মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি ১০০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধি কিভাবে হতে পারেন, যেখানে ৯৫ শতাংশ ভোটার তাদের মতামত প্রদান করেননি।
করোনার বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশও প্রস্তুতি নিচ্ছে এই সমস্যা মোকাবিলায়। করোনা যখন এদেশেও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সেই সময় এই ভোটের প্রয়োজনীয়তা কতটা ছিল সেই প্রশ্নও উঠেছে।
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম এই মুহূর্তে ভোটের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ভোটের আয়োজন করা হয়েছে।
দেশের ওই পরিস্থিতিতেও যে নির্বাচন কমিশন সংবিধান নিয়ে ভাবছে, এই জন্য তারা ধন্যবাদের দাবিদার। তবে যাদের জন্য সংবিধান, যাদের জন্য ভোট—সেই ভোটাররাই তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে। জীবনের চাইতে সংবিধান বড় হতে পারে না, সেটা ভোটাররা ভোটকেন্দ্র না গিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর হোসেন অন্য একটি ব্যাখ্যা নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, একটি ভোট পড়লেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। নির্বাচনে প্রার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক।
আসুন আমরা অংশগ্রহণমূলকের সংজ্ঞা জেনে নেই। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুসারে অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে সমাজের সবাইকে অনুমতি দেওয়া একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করার জন্য (allowing everyone in a society, business, etc. to give their opinions and to help make decisions)। সেই হিসেবে ঢাকার উপনির্বাচনকে কী অংশগ্রহণমূলক বলা যায়?
ইসি সচিবের মন্তব্য থেকে অন্য আরেকটি প্রশ্ন জন্ম নিতে পারে। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে প্রার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক। সে হিসেবে সাম্প্রতিক অতীতে অনেক নির্বাচনে বেশিরভাগ দলই অংশ নেয়নি, সেক্ষেত্রে সেই নির্বাচনগুলো কি অংশগ্রহণমূলক ছিল?
শুধু ভোটাররাই নন, সাংবাদিক বা দেশের জনগণের কি আগ্রহ ছিল এই নির্বাচনে? কেউ কি টেলিভিশনে কিংবা সংবাদমাধ্যমে চোখ রেখেছিলেন এই নির্বাচনের ফলাফল জানতে?
সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদেরও এই নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে অনীহা ছিল। জনগণের এই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহের কথা চিন্তা করেই আমাদের এই অনীহা। রিপোর্ট লিখার সময় আমরা পাঠকের আগ্রহের কথা মাথায় রেখেই সংবাদ পরিবেশন করি। আমার মনে হয়েছে এই সংবাদের পাঠকের সংখ্যাটা নেহায়েতই সামান্য।
শুধু কি ভোটার, ধানমন্ডি ও লালবাগ মিলিয়ে ঢাকা-১০ আসনে প্রদত্ত ভোটের চাইতে অনেক বেশি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও নেতা আছেন। তারাও কেন ভোট দিতে গেল না সেটাও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভাবা দরকার।
পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য: প্রধান প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments