ভেনিসে করোনা সংক্রমণ কম কেন?
পিয়াচ্ছা সান মারকো বা সান মার্কস স্কয়ার। ইউরোপের বৈঠকখানা বলে সর্বাধিক পরিচিত। এত বিশাল ও নয়ন জোড়ানো খোলা চত্বর ইউরোপে দ্বিতীয়টি নেই। এখানে আছে ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ক্যাথলিকদের বাজিলিকা দি সান মারকো গির্জা। বিশাল উঁচু টাওয়ার, যার চূড়া থেকে গোটা ভেনিস দেখা যায়। আছে ১৪২৪ সালের পালাচ্ছও বা বিশ্ববিখ্যাত দোজি মিউজিয়াম। প্রতিবছর ভেনিসে যত পর্যটক আসেন তারা প্রত্যেকে একবার হলেও সান মারকো চত্বর দেখতে যান। এটাই ভেনিসের প্রাণকেন্দ্র।
বাঙালিদের মধ্যে যেমন ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ বলে প্রবাদ আছে, পিয়াচ্ছা সান মারকোও তেমন। এখানেও ‘বারো মাসে তেরো উৎসব’ লেগে থেকে। সব সময় লোকে-লোকারণ্য। ভেনিস দেখতে আসা সব মানুষের পথ শেষ হয় সান মার্কস স্কয়ারে। অথচ আজ ধু ধু মাঠে পরিণত হয়েছে এই জনপ্রিয় পর্যটক কেন্দ্র। কোথাও জনমানুষ নেই, কেউ নেই। প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে করোনা আতঙ্কে।
অদৃশ্য করোনাভাইরাসের কাছে যখন গোটা ইতালি পরাজিত হয়ে একটা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করছে, ঠিক তখনও ভেনিসবাসীর মধ্যে তুলনামূলক স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। করোনা আক্রান্ত অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় ভেনিসে এর সংক্রমণ অনেক কম। ভেনিসের হাসপাতালে অল্প কজন করোনা রোগীর চিকিৎসা চলছে। যাদের অধিকাংশই সুস্থতার পথে।
এ বিষয়ে আমার কথা হয় সময় টিভির সাংবাদিক ভেনিস অভিবাসী মাকসুদ রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভেনিস তো আসলে একটা দ্বীপ। একমাত্র স্থলযান ছাড়া অন্যান্য আধুনিক শহরের সব সুযোগ-সুবিধা এই শহরে থাকলেও এটা ভৌগলিক কারণেই বিচ্ছিন্ন একটা শহর। তাছাড়াও, এখানকার বাসিন্দারা সবাই এক জায়গায় থাকেন না। ছোট-বড় প্রায় একশ দ্বীপের সমন্বয়ে ভেনিসের মূল ভূখণ্ড।
এই শহরের জনচলাচলসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ। ভেনিস একটা ঘরের মতো। সমুদ্র ছাড়া ভেনিসের একমাত্র প্রবেশদ্বার পিয়াচ্ছালে রোমা। সেখানে সামান্য একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেই ভেনিস অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
মাকসুদ রহমান মনে করেন, এই সুবিধা থাকার কারণেই ভেনিসে তুলনামূলক করোনার সংক্রমণ কম হয়েছে। অন্যান্য শহরগুলো ইচ্ছা করলেও ভেনিসের মতো সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। যে কারণে তারা পুরাপুরি লকডাউনও হতে পারছে না।
তিনি আরও জানান, ইতালিতে করোনা সংক্রমণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার মাত্র কদিনের মধ্যে ভেনিস ফাঁকা করে সব পর্যটক চলে গেছেন। তখন থেকেই প্রশাসন ভেনিসকে কড়া নজরদারিতে রেখেছে। ভেনিসে ঢুকতে-বেরুতে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অকারণে ঘোরাঘুরির চেষ্টা করলেই অর্থদণ্ডের মুখে পড়তে হচ্ছে।
জোভান্নি পাতালোচ্ছি একজন প্রবীণ ইতালীয়। অল্পকিছু দিন আগে স্ত্রী-বিয়োগ হওয়ায় তিনি একা থাকেন। টুকটাক বাজার-সদাই একাই করেন। করোনা সংকট সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে তিনি ঘরেই আছেন। ডাক্তারের পরামর্শে বাইরে বের হন না। খাবার-দাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনে তার এক মেয়ে আসে পাশের উপশহর মেসত্রে থেকে। বাবার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ঘরের দরজায় পৌঁছে দেন তিনি।
জোভান্নি পাতালোচ্ছি বলেন, ‘ভেনিস কোনো সাধারণ শহর নয়। সাগরের বুকে ভাসমান এই শহরকে যদি মস্ত এক মিউজিয়াম বলি তাতেও ভুল হবে না।’
তিনি জানান, ভেনিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এখানে ঢোকা বা বের হওয়া এখন সহজ নয়। তাছাড়া পর্যটক না থাকলে ভেনিস এমনিতেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পর্যটক না থাকার কারণে ভেনিসে যারা কাজ করতে আসেন তাদেরও এখানে আসার দরকার হচ্ছে না। যারা ভেনিসে আছেন তাদের জন্য সুপারশপ এবং ফার্মেসি খোলা আছে। সুতরাং পরিবেশগত কারণেই ভেনিসে ভাইরাস মহামারি ছড়ানো সহজ নয়।
জোভান্নি পাতালোচ্ছির কথার সঙ্গে পুরাপুরি একমত নন ক্লাউদিয়া বেরালদো। তিনি বিশ্বাস করেন, ভেনিস হলো পবিত্র জায়গা। বহু মানুষের জীবিকার উৎস। এখানে প্রতিবছর রোগ-বালাই থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় রেদেনতোরে বা আতশবাজির উৎসব করা হয়। বাজিলিকা দি সান মারকোয় নিয়মিত প্রার্থনা করা হয়। সুতরাং ভেনিসে কোনো সংক্রমণ মহামারি আকার ধারণ করবে না।
উল্লেখ্য, ভেনিসের প্রবীণ মানুষদের মধ্যে অনেক প্রবাদ চালু আছে। তারা নানা করম বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। ভেনিসের প্রায় সব মানুষ বিশ্বাস করেন এই শহরে মৃত মানুষের আত্মা ঘোরাঘুরি করে। তারা মাঝে-মাঝে মানুষের রূপ ধরে সামনে আসে। কিন্তু, কারো ক্ষতি করে না। ভেনিসকে পাহারা দেয়।
ভেনিসবাসীর আরেকটা বিশ্বাস হলো— পিয়াচ্ছা সান মারকোয় যে কবুতর আছে ওগুলো সবার হাতে বসে খাবার খায় না। যারা মন্দ মানুষ তাদের হাতে সান মারকোর কবুতর বসে না।
প্রবাসী রাজনীতিক আবদুল আজিজ সেলিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেক অভিবাসী সামাজিক মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন। তারা সামাজিক, পারিবারিক সাধারণ বিধিনিষেধ অতিক্রম করে মানুষের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করছেন। যা কোনোভাবেই উচিৎ নয়।
তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যমে ভয় বা গুজব ছড়ানো বন্ধ করা দরকার। তা না হলে যারা প্রবাসে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এবং দেশের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়তি চাপে থাকতে হয়। মানসিক উত্তাপ বৃদ্ধি পায় যা প্রায় সময় মানবিকতার মাত্রা অতিক্রম করে।
Comments