আন্তর্জাতিক

করোনা প্রতিরোধে সহজলভ্য কিট ও সাড়া জাগানো কোরিয়া মডেল

করোনাভাইরাস থেকে ‘কোভিড ১৯’ বিশ্বময় আতঙ্কের নাম। দক্ষিণ কোরিয়াতেও করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু, আতঙ্ক কম বা নেই। যদিও গত সপ্তাহ পর্যন্ত কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল চীনের পরেই।
Korea lab
ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস থেকে ‘কোভিড ১৯’ বিশ্বময় আতঙ্কের নাম। দক্ষিণ কোরিয়াতেও করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু, আতঙ্ক কম বা নেই। যদিও গত সপ্তাহ পর্যন্ত কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল চীনের পরেই।

করোনার মতো ঘাতকশ্রেণির ছোঁয়াচে সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে কোরিয়ার লড়াই সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অত্যন্ত সহজলভ্য টেস্ট কিট, যত্রতত্র করোনা পরীক্ষার অত্যাধুনিক সুযোগ, প্রযুক্তি-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার শুধু বাংলাদেশের মতো দেশের জন্যে নয়, পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের জন্যেও কল্পনার বিষয়। কোরিয়া যা বাস্তবে প্রয়োগ করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। করোনা প্রতিরোধের এই কোরিয়ান মডেলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এর আগে প্রযুক্তি নিয়ে লিখেছি। আজ মূলত করোনা পরীক্ষার কিট নিয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই। গত লেখার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে প্রশ্ন করেছেন ‘ড্রাইভ থ্রু’ পদ্ধতিতে কী করে করোনা পরীক্ষা সম্ভব? কারণ করোনা পরীক্ষার ফল পেতে তো দু-তিন দিন সময় লেগে যায়। সেখানে গাড়ি নিয়ে অস্থায়ী অত্যাধুনিক ল্যাবে যাবে, গাড়িতে বসা অবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মী রক্ত নিবেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে শনাক্ত হয়ে যাবে তিনি করোনা আক্রান্ত কিনা। হ্যাঁ, বিষয়টি এমনই। কোরিয়া এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। টেস্ট কিট এখন সারা পৃথিবীর আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের কাছে যেমন পর্যাপ্ত টেস্ট কিট নেই, নেই আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশের কাছেও। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকাই মূলত বিপদের কারণ হয়েছে। এখন নানা রকমের অজুহাত সামনে আনা হচ্ছে।

কোরিয়ার টেস্ট কিটের কথায় যদি আসি, তবে নজর দিতে হবে তাদের পূর্ব প্রস্তুতি দিকে। ২০১৫ সালে মার্স (Middle East respiratory syndrome; MERS) ভাইরাসে আক্রান্তের সময় কোরিয়ান কিছু বায়োটেকনোলজি কোম্পানি এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় মার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করে। ওই সময়ে রিয়েল-টাইম রিভার্স-ট্রান্সক্রিপশন পলিমেরেজ চেইন রিঅ্যাকশনের (rRT-PCR) ভিত্তিতে ছয়টি বাণিজ্যিক আরএনএ (RNA) শনাক্তকরণ কিট তৈরি করা হয়েছিল।

কোরিয়ার সেই গবেষণা কাজে দেয় ২০১৯ সালের শেষের দিকে উহানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর। কোরিয়ান কোম্পানিগুলো করোনার টেস্ট কিট উৎপাদনের চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করে। তখনও কিন্তু কোরিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি।

প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুততম সময়ে কিট উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করতে সক্ষম হয়েছিল সরকারি সংস্থা কোরিয়া সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (কেসিডিসি) আন্তরিক ও তাত্পর্যপূর্ণ তাৎক্ষণিক সহযোগিতার কারণে।

যেমন, বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষকরা স্বল্প মূল্যের করোনাভাইরাস কিট উদ্ভাবন করেছে বলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছেন। কোরিয়ান গবেষকরা মার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট তৈরি করেছিলেন। ডা. বিজন কুমার শীল সার্স ভাইরাসের কিট তৈরি করেছিলেন। ঘটনাটি যদি কোরিয়ার ক্ষেত্রে হতো, এতদিনে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিট উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু করে দিতে পারতো। সরকারি সহযোগিতাতেই পারতো। ২০ কোটি টাকার জন্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে ব্যাংকের পেছনে ঘুরতে হতো না, ইউএসএআইডির সঙ্গে মিটিংও করতে হতো না। সম্পূর্ণ দায়িত্ব কোরিয়ান সরকার নিয়ে নিতো।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধের অন্যতম উপায় শনাক্তকরণ। যেহেতু সাধারণ ফ্লু আর করোনাভাইরাস আক্রান্তের পার্থক্য নির্ণয় কঠিন, সেহেতু দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণই সমাধান।

কোরিয়ান কিট প্রস্তুতকারী কোম্পানির মধ্যে PowerChek (Kogene Biotech, Korea), DiaPlexQ (SolGent, Korea), Anyplex (Seegene, Korea), AccuPower (Bioneer, Korea) সহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান করোনা টেস্ট কিট বাজারে এনেছে। যেগুলো দিয়ে ১০ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে করোনা পরীক্ষার ফল জানা যায়। যতদূর জানতে পেরেছি টেস্ট কিট ব্যবহারের জন্য সর্বাধুনিক পিসিআর (polymerase chain reaction) মেশিন ও কোরিয়ার কয়েকটি হাসপাতালে আগে থেকেই ছিল। নতুন করে আরও পিসিআর মেশিন হাসপাতাল ও অস্থায়ী ল্যাবগুলোতে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিদিন ২০ হাজার বা তারও বেশি করোনাভাইরাস পরীক্ষার সক্ষমতা আছে এবং তা করেছে। যেখানে বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা করা হয় ৯২ জন।

কোরিয়ান সরকার অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের লিফটে অ্যান্টি-ভাইরাস ফিল্ম লাগিয়ে দিয়েছে যার ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হবে না। ছবি: এমএন ইসলাম

কেসিডিসি সরাসরি সংক্রমিত এলাকার হাসপাতাল, ক্লিনিক, ড্রাইভ থ্রু (Drive thru)  ল্যাবসহ সারাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ টেস্ট কিট পৌঁছে দিয়েছে। করোনা টেস্ট কিট চাহিদা মতো দেশের যে কোনো প্রান্তে সরবরাহ ও পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কেসিডিসি প্রযুক্তির সবোর্চ্চ সহায়তা নিয়েছে। এই সময় কোরিয়ানদের কৌতূহল আর আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন একজন সরকারি আমলা-পরিচালক জুং ইউন খিয়েন (Jung Eun-kyeon)। তিনি প্রতিদিন কোরিয়ানদের সব তথ্য নিখুঁতভাবে জানিয়েছেন। তিনি কোরিয়ান সরকারের কথা বলেছেন। কোরিয়ার মানুষ তার কথা বিশ্বাস করেছেন। তাকে একবারও বলতে হয়নি ‘গুজব’ ছড়াবেন না। সরকারি আমলার কথা অসত্য, এমন মানসিকতা নিয়ে কোনো কোরিয়ান তার কথা শোনেননি। কোরিয়ান সরকার কাজ দিয়ে এই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে এও বোঝা গেল, কোরিয়ান আমলাতন্ত্র জনগণের কতটা আপন।

কোরিয়ান সরকার সব নাগরিকের বিনামূল্যে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। করোনা পরীক্ষা তো বিনামূল্যে বটেই। এমনিতেই জাতীয় স্বাস্থ্য বীমার আওতায় সব নাগরিক ও কোরিয়ায় অবস্থানরত বিদেশিরা স্বল্প মুল্যে মোটামুটি সব ধরনের চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। যেখানে অনেক উন্নত দেশ সন্দেহভাজন রোগীদের শনাক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট পেতে লড়াই করেছে, তখন দক্ষিণ কোরিয়া সহজলভ্য জিনিসের মতো করোনার কিট বিনামূল্যে পরীক্ষার জন্য ডাক্তার বা হাসপাতালের নাগালে নিয়ে গেছে।

চিকিৎসক বা সেবা কর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) নিয়ে কথা হচ্ছিল একজন কোরিয়ান বন্ধুর সঙ্গে। জানতে চাইলাম, টেস্ট কিটের মতো পিপিই নিয়েও কোনো আলোচনা দেখছি না কোথাও। কোরিয়ান বন্ধু বললেন, ‘আলোচনা থাকতো যদি ঘাটতি থাকতো। কোরিয়াতে পিপিই পর্যাপ্ত পরিমাণ আছে, বেশি আছে।’

বিগত কয়েক সপ্তাহের কোরিয়ান পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিট বা পিপিই সংকট বা চিকিৎসা সেবার নূন্যতম গাফলতি বা সীমাবদ্ধতার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। কিট ও মাস্ক প্রস্তুতকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্যে বোঝা যায় সত্যিকারের যুদ্ধের মতো ২৪ ঘণ্টা তারা কাজ করছেন। সিজেনি (Seegene) নামক কিট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য থেকে জানা যায়, ২৪ জানুয়ারি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল অর্ডার দেওয়ার চার দিনের মধ্যে তা পেয়েছে। ৫ ফেব্রয়ারির মধ্যে তারা টেস্ট কিটের প্রথম ভার্সন প্রস্তুত করে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানটি ম্যানুয়ালি কাজের পরিবর্তে তাদের সংগৃহীত ডাটার ভিত্তিতে বেশ কিছুদিন আগে  ইউরেথ্রাইটিস, মূত্রনালী প্রদাহের জন্য রোগ নির্ণয়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স-ভিত্তিক রিসার্চ সিস্টেম ডিজাইন করে, যেটা করোনার টেস্ট কিট প্রস্তুতের সময় কাজে লাগায়।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে কোরিয়ায় করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়ার ফলে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইনের তৎপরতা ছিল দেখার মতো। এর মাধ্যমে কোরিয়ানদের কাছে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। তিনি যা বলেন, কোরিয়ানরা তা বিশ্বাস করেন। তিনি কিট তৈরিতে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করেছেন।

কিছু কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে ও টেস্ট কিট রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, দক্ষিণপুর্ব এশিয়া, আমেরিকা মহাদেশেও কিট রপ্তানি শুরু করেছে। প্রতিটি টেস্ট কিট প্যাকেজের মূল্য ১০ থেকে ১৫ মার্কিন ডলার।

কোরিয়ার আরেকটি ব্যতিক্রমী দিকের কথা বলি। ১০০টিরও বেশি দেশ কোরিয়ানদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু, কোরিয়ান সরকার কোনো দেশের নাগরিকদের কোরিয়া ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। কোরিয়ার বিমানবন্দর আগের মতোই চলছে। বিমানবন্দরে আসা যাত্রীদের সবাইকে কিউআর কোড দিয়ে অ্যাপ ডাউনলোড করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটাকে বিশ্বের প্রথম সেলফ কোয়ারেন্টিন অ্যাপ বলা হচ্ছে। অ্যাপে সবাই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয় থার্মাল মেশিনে চেক করছেন। করোনার উপসর্গ না পেলে বের হয়ে আসছেন। অ্যাপের মাধ্যমে সরকার ১৪ দিন ওই ভ্রমণকারীকে ট্র্যাকিংয়ে রাখছে। যদি করোনার উপসর্গ পাওয়া যায়, বিমানবন্দরেই পরীক্ষা করে আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুদিন আগেও তিনজন ইরানি শনাক্ত হয়েছেন। সব দেশের নাগরিকদের চিকিৎসার একই রকম সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন কয়েকদিন আগে বলেছেন, কোরিয়া মানুষের মৌলিক অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় এবং  চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সবার আছে। সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই।

কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের যুদ্ধ রোগের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে নয়।’ কোরিয়াতে বসবাসরত বিদেশিদেরও কোরিয়ান সরকার কোরিয়ান নাগরিকদের মতো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।

কোরিয়ান সরকার করোনা মোকাবিলায় নানা সতর্কতামূলক উদ্যোগ নিলেও, প্রায় সর্বত্র সবকিছু স্বাভাবিক। সরকারের তাৎক্ষণিক ও কার্যকর কিছু উদ্যোগ মানুষকে স্বাভাবিক থাকতে সহায়তা করছে। না চাইতে বা না ভাবতেই কিছু সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সরকার। যেমন, হঠাৎ করে দেখা গেল অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের লিফটে অ্যান্টি-ভাইরাস ফিল্ম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানে এই ফিল্মে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হবে না। অল্প সময়ে এমন অভিনব উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English

Witnessing atrocities in Gaza on social media

Social media's addition as a new paradigm to news dissemination and consumption is not a recent development. Yet, with the ongoing Israeli attack and occupation of Gaza, it is playing a more prominent role than usual, given the deep differences that exist between how news from the region is being packaged by media outlets in the West and the rest of the world

1h ago