কোভিড-১৯: বিশ্ব কি বদলে যাবে?

এই গতকাল বা পরশুও যে মানবজাতিকে মনে হতো শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে সেরা। যার হাতের মুঠোতে বিশ্ব। গ্রহ থেকে গ্রহান্তর যার ভাবনায়। যে অস্ত্র বানায়, একের পর এক সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলে মুহূর্তে। যে যুদ্ধ করে, নিজেরই বিরুদ্ধে।
Corona London
করোনা আক্রান্ত লন্ডনে বাসের জন্যে অপেক্ষা। ২৫ মার্চ ২০২০। ছবি: রয়টার্স

এই গতকাল বা পরশুও যে মানবজাতিকে মনে হতো শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে সেরা। যার হাতের মুঠোতে বিশ্ব। গ্রহ থেকে গ্রহান্তর যার ভাবনায়। যে অস্ত্র বানায়, একের পর এক সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলে মুহূর্তে। যে যুদ্ধ করে, নিজেরই বিরুদ্ধে। মানুষই মানুষকে শক্র বানায়। যুদ্ধের নামে খেলে শত্রু-শত্রু খেলা। সেই মানুষ এখন সবচেয়ে বড় যুদ্ধের মুখোমুখি। শত্রু অদৃশ্য, অচেনা। এতো এতো পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র, ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্রবাজার— কিছুই কাজে আসছে না। মানুষ এখন একলা, মানুষ এখন নিঃস্ব।

অথচ কী আশ্চর্য, মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ানো এখন নিষিদ্ধ। করোনাভাইরাস ফাঁদ পেতেছে, জাল বুনেছে মানুষেরই শরীরে। সেই মানুষের জালে মানুষের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে মানুষ। পাখির মতো মরে যাচ্ছে মানুষ, মানুষ-বোমার ঘায়ে। হায় মানুষ! তোমার ইতিহাসে কি এক নিকষ কালো অধ্যায় তুমি পাড়ি দিচ্ছো! একা, বড্ড একা।

কে জানে, এই কালো অধ্যায়ের পর কী আছে মানুষের জীবনে। হয়তো নতুন যে পৃষ্ঠা আসবে, সেখানে বদলে যাবে মানুষের গল্প। নতুন করে লেখা হবে মানুষের রোজনামচা। রাজনীতি বদলে যাবে, বদলে যাবে নিরাপত্তাব্যবস্থা। মানবতা বা মানবিকতাতো আমরা কবেই হারিয়ে ফেলেছি। এবার হয়তো বদলে যাবে সম্পর্ক, বদলে যাবে প্রেম, ভ্রাতৃত্ববোধ। এই যে একটা লম্বা সময় একযোগে সারা বিশ্বের মানুষ চর্চা করছে মানুষ থেকে দূরে থাকার, ছোঁয়া-বাঁচিয়ে চলার। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কি পড়বে না মানুষের জীবনচর্চায়, জিনে?

যন্ত্রের এই পৃথিবীতে এমনিতেই মানুষ হয়ে উঠছিল একা। তারপরও অদৃশ্য প্রচারণা ছিল একাকীত্বের বিরুদ্ধে। তিরতির করে জেগে থাকা সৌহার্দবোধ মানুষকে একত্রিত থাকার মন্ত্র শোনাতো, সমবেত থাকার সুবিধা চেনাতো। অথচ একাকীত্বের ধারণা এখন পাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। দৃশ্যমান প্রচারণা— একা হয়ে যাও। একাই যেন নিরাপদ, একাই নিশ্চিন্ত। মানুষের ইতিহাস যুথবদ্ধতার ইতিহাস। অথচ আজকের নতুন বিশ্বের একা থাকাই মূলমন্ত্র।

এতদিন জেনেছি একা মানেই পরাজয়। আমাদের প্রজন্মেই আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার পর আমেরিকাকে নেতা হতে দেখলাম। শীতল যুদ্ধের দুই ব্লকের দৃশ্যমান রাজনীতির অবসান হয়ে গেলেও এতোদিনেও দলভারি করার বিশ্ব-রাজনীতিই প্রচলিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য সংকট থেকে শুরু করে এই বাংলাদেশের নির্বাচন, রাজনীতি সবখানেই দলীয় সমাচার। সেই বিশ্ব দলাদলিকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে যেন এলো করোনাভাইরাস। যার যার মতো লড়ো, একা একা লড়ো। কৌটিল্য থেকে সুনঝু পর্যন্ত এতোদিন যত যুদ্ধবিদ্যা চালু ছিল পৃথিবীতে সেগুলোর সব ছিল চেনা শত্রুর বিরুদ্ধে। তাই ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ এমন তত্ত্বও চালু থেকেছে এতোদিন। এবার দেখা গেল শত্রু যখন অচেনা, তখন তা সবার শত্রু। শত্রু সবসময়ই শত্রুই, কোন ফর্মুলাতেই সেই শত্রু কারো বন্ধু নয়। সেই শত্রুর বাহন আবার মানুষ। সুতরাং দৃশ্যমানভাবে এখন চেনা পৃথিবীতে মানুষই মানুষের শত্রু।

এ শতাব্দীর শুরুতে ৯/১১ এর ঘটনা মানুষের নিরাপত্তাবোধকে পাল্টে দিয়েছে সমূলে। এই যে বন্দরে বন্দরে এতো তল্লাশি, এতো অবিশ্বাস, এতো সাবধানতা— সব কিছুই চেপে বসেছে ৯/১১ এর পর। এর আগেও বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব অনেক সাধারণ ছিল। অনেক আটপৌঢ়ে ছিল। একবিংশ শতাব্দীর শুরুই হয়েছে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস রচনার মধ্য দিয়ে। আস্ত দুটো বিমান, বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের আকাশচুম্বী ভবন যুগল আর প্রায় ৩০০০ প্রাণ সেই অবিশ্বাস পোক্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। যতটা পোক্ত করেছিল তার সপ্তাহখানেক বাদে ছড়িয়ে পড়া এনথ্রাক্স নামের রাসায়নিক। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে হলে, কোন সভা-সমাবেশে অংশ নিলে, অফিস-আদালতে ঢুকতে হলে এই যে নিরাপত্তার চাদর, সেটা তো মানুষকে অবিশ্বাস করা হয় বলেই।

সেই অবিশ্বাসকে যে আরও মজবুত করে দিতে আসেনি করোনা নামের ভাইরাসটি, তাই বা কে বলবে? চলমান মহামারির বিরুদ্ধে একদিন মানুষের জয় আসবেই, নিশ্চিত। কারণ, প্রজাতি হিসেবে মানুষ এতো দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার মতো দূর্বলও নয়। গত জানুয়ারির শুরুতে ইসরাইলি অধ্যাপক নোয়া হারারি আশঙ্কা করেছিলেন— একদিন মানুষের বদলে পৃথিবী শাসন করবে অন্য কেউ, হয়তো বা ইঁদুর। অতোটা জ্ঞানী নই, তাই এখনো মানুষের উপরই আমার আস্থা প্রবল। যতই ঢেউ আসুক, মানুষ বেঁচে থাকবে, মানুষ জেগে থাকবে। ‘কোভিড ১৯’ এর সঙ্গে যুদ্ধে জয় হবে মানুষেরই। তবে হয়তো মানুষের প্রকৃতি বদলে যাবে। হয়তো অবিশ্বাস আরও বাড়বে। যে অবিশ্বাস, যে সন্দেহ রসদ জোগাবে আবার বড় কোন যুদ্ধের, মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের। হয়তো একারণেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যৌক্তিকতা খুঁজে পাবে। দুই মাস হোক বা বড় জোর দশ মাস, করোনা বিদায় হবেই। কিন্তু, কোভিড-পরবর্তী যে পৃথিবীটা রয়ে যাবে, সেটাও আসলে মানুষের জন্যই সংকটের, মানুষের জন্যই আতঙ্কের, মানুষের জন্যই দূর্ভাবনার।

 

“মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,

মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও,

মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে,

সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে।

মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও,

এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও,

মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।”

— শক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

শেগুফতা শারমিন, উন্নয়নকর্মী

[email protected]

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

6h ago