এই পতাকা আর আমাদের নয়, আমাদের নতুন পতাকা-দেশ হবে
আমি তখন অনেক ছোট। আমরা তখন ঢাকার ভূতের গলিতে থাকতাম। আমাদের মানে বাচ্চাদের সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর খেলা ছাড়া কোনো কাজ নেই। স্কুল তেমনভাবে চলছিল না। দেশ, দুঃখ, কষ্ট, রাজনীতি, সমাজনীতি কী, কেন, তা-ও জানতাম না। শুধু লক্ষ করতাম সন্ধ্যা নামার পরপরই কেমন যেন একটা সুনসান নীরবতা চারিদিকে।
আব্বা, নজলু চাচা, কলিম ভাই, টুনু খালু ও পাড়ার দুএকজন মুরব্বি একখানে হয়ে ফিসফিস করে কথা বলতো। আব্বা সাংবাদিক ছিল বলে সবাই আব্বার কাছে এসে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইতো। আম্মা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে কথা শুনতো। মাঝে মাঝে আব্বারা সবাই মিলে শরীফ চাচা ও জাহানারা চাচির (জাহানারা ইমাম) বাসায় যেত আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য।
সকাল-সন্ধ্যায় শুধু বিবিসি শুনতো সবাই। সেই থেকে বিবিসি আমার খুব আপন একটা গণমাধ্যম। তবে আমি সে সময় এসব ঘটনার খুব একটা গুরুত্ব বুঝতাম না, বোঝার কথাও না। তবে শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো কোনো প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘটনা, যা মনে দাগ কেটে যায়, তা শিশুরা মনে রাখতে পারে। সেই একটি রাত সেই শিশু আমাকে অনেকটাই পরিণত করে তুলেছিল। ২৫ মার্চের কালরাত ঠিক সে রকমই একটি রাত। যা আমি কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারবো না। রাতের খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ চারিদিক থেকে গুলি, মেশিন গান এবং আরও অনেক শব্দ ভেসে আসতে থাকলো। আব্বা, আম্মা, আমি লাইট নিভিয়ে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের কাছে ছিল কিছু শুকনো বিস্কুট আর একটা ছোট্ট হারিকেন। পরে শুনেছি ওই সময় বা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্ল্যাক আউট চলছিল। কারণ পাকিস্তানিরা যেন নির্বিঘ্নে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি আমার ছোট দুইটা পুতুল নিয়ে খাটের নিচে ঢুকেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, যদি দুষ্টু লোকেরা আসে, তাহলেতো আমার পুতুল দুইটা নিয়ে যাবে। সেদিন ভাবিনি ওই হায়েনারা আমার দেশকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য এই রাতে বর্বর হামলা চালিয়েছিল। শুধু আমার পুতুল কেন, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ওরা নির্বিচারে। অগণিত নারী-শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
আমি সেই রাতেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আব্বা কী হচ্ছে চারিদিকে? এত গুলির শব্দ, এত আগুনের আলো কেন দেখা যাচ্ছে? ওরা কি আমাদের মেরে ফেলবে?’ কী ভয়ঙ্কর ট্রমা হয়েছিল তখন, তা আমি এখনো কল্পনা করতে পারি না। আমাদের দৈনন্দিন সাদামাটা কিন্তু আনন্দময় জীবনে কী ভয়াবহ একটা ঝড় এসেছিল। আব্বা বলেছিল, ‘মা পশ্চিম পাকিস্তান নামে একটা শয়তান দেশ আছে, ওরা আমাদের দেশকে কেড়ে নিতে চায়। আমাদের সবাইকে যুদ্ধ করতে হবে। শুনিস নাই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হও। যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমার মনে পড়লো আব্বার কাছে শোনা সেই বক্তৃতার কথা। আব্বা বলেছিল, কাঁদিস না মা। তুই তোর পুতুল সামলা, দেশের মানুষ দেশটাকে সামলাবে।’
আম্মা আমাকে বুকে চেপে ধরে শুধু দোয়া পড়ে যাচ্ছিল। এত গোলাগুলির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল, হয়তো আমাদের পাড়ায় কেউ বোমা ফেলছে। এত কমলা রঙা আগুনের ঝলকানি দেখে মনে হয়েছিল, এক্ষুণি হয়তো একটা আগুনের গোলা এসে পড়বে আমাদের অন্ধকার ঘরে। নিশ্চুপ একটা রাতে শুধু বোমা আর গুলির শব্দ শুনে আমি ভয়ে কাঁদতে থাকলাম। আব্বা আমার মুখ চেপে ধরে আস্তে আস্তে কাঁদতে বললো। আব্বা ফিসফিস করে বললো, ‘গুলির আওয়াজ আসছে রাজারবাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে।’ আমার মনে হয়েছিল, ওরা মনে হয় মানুষ না। আমার ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে পড়া সেই দানোর দল, যাদের মুখ থেকে আগুন বের হয়। বড় হয়ে বুঝেছি, ওরা আসলে সেই দানবই ছিল।
এরপর যে কখন আম্মার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ভোর হলো। আমরা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম। রাতের আঁধার কেটে যাওয়াতে আমি শান্তি পেলাম কিন্তু তখনো জানি না কেবল অশান্তির শুরু হলো। আব্বা কাজে বেরিয়ে গেল। আম্মাকে বলে গেল আমাকে যেন কোথাও যেতে না দেয়। শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছু চাল, ডাল, আলু, তেল, লবণ, মোমবাতি আর ম্যাচ কিনে রাখতে বললো পাড়ার দোকান থেকে।
তখন পুরো পাড়ায় একটাই ফোন ছিল, সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ চাচার বাসায়। আব্বা কাজ করতো অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানে (এপিপি)। এখন বাসস। দুপুরে আব্বাকে ফোন করে জানলাম যে শহরের অবস্থা খুব খারাপ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নেমেছে। ওরাই গত রাতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। শহরের অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। পুলিশ, ছাত্র-ছাত্রী কেউ বাদ যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেছে। আম্মা ফোন রেখে কাঁদতে শুরু করল। আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরে এলো। আব্বা বলে দিলো আমি না আসা পর্যন্ত তোমরা সাবধানে থেকো।
১৯৭১ এর সেই রাতটা ছিল বিশ্বাসঘাতকতার রাত। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, পাকিস্তানের কসাই টিক্কা খান। শুধু মুসলমান হিসেবে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, সেই জন্মের সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধিতা করেছিল। তারাই চেয়েছিল তদানীন্তন সবুজ পূর্ব পাকিস্তানকে দুমড়ে-মুচড়ে ধ্বংস করে দিতে। তাই শুরুতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে ধরে আমাদের নেতৃত্বহীন করতে চেয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতের এই নৃশংস পরিকল্পনা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছিল রাও ফরমান আলী ও খাদিম হোসেন রাজার। তারা আলোচনায় আমাদের ব্যস্ত রেখে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে করে লাখ লাখ আর্মি আর অস্ত্র এনে হাজির করেছিল ঢাকায়। আমাদের যখন গণহারে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানের টপ বসরা বসে অপারেশন সার্চলাইট এনজয় করছিল। অপারেশনটা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে। ওদের বার্তাটি ছিল এমন ‘বিগ বার্ড ইন দ্য কেইজ’। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে ধরলেই খেল খতম হবে। কিন্তু ওরা জানতো না ৭ কোটি বাঙালির শক্তি কতটা।
২৬ মার্চ শুনলাম আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি। বুঝিনি ব্যাপারটা কী। পাকিস্তানিরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে, দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কেউ বাসা থেকে বের হবে না। আমরা আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। আব্বা সেদিন বাসায় এসে বলল, ‘মা আজ থেকে আমরা স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের নতুন দেশের নাম হবে বাংলাদেশ। আমরা আজ থেকে যে, যেভাবে পারি যুদ্ধ করবো পাকিস্তানি দৈত্যদের বিরুদ্ধে।’ সেই বয়সে আমাকে বোঝানোর জন্য দৈত্যটাই সবচেয়ে সঠিক শব্দ ছিল। আব্বা সেদিন পাকিস্তানের পতাকাটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘এই পতাকা আর আমাদের নয়, আমাদের নতুন পতাকা হবে, নতুন দেশ হবে। ভয় পাস না। তুই দেখে নিস আমরা যুদ্ধে জয়ী হবোই। আব্বার কথাই সত্য হলো— এর প্রমাণ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগকর্মী
[email protected]
Comments