‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে!’

dolphin-1.jpg
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে খেলছে ডলফিন। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

দুই দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিওচিত্র ঘুরছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে ভিডিওটি। তাতে দেখা যাচ্ছে- কক্সবাজারে সৈকত ঘেঁষা সমুদ্রে খেলছে ডলফিন। সাদা আর কালো রঙের ডলফিনেরা মনের আনন্দে নাচছে। মাথা তুলে ছুটছে। আবার গোটা শরীর পানির উপরে ছুড়ে দিয়ে আবার ঝপ করে ডুব মারছে পানিতে। এই সমুদ্রে ডলফিন ছিল, তা আগে হয়তো কারো দেখা হয়নি। এখন দেখলেন। সমুদ্রতীরে মানুষের আনাগোনা নেই। নেই সমুদ্রে নেমে ঝাঁপাঝাঁপি। সর্বোপরি নেই সমুদ্রে ময়লা ফেলার মচ্ছব। তাই নিজেদের সমুদ্রের দখল পেয়েই বুঝি ডলফিনগুলো মনের আনন্দে এই নাচানাচি করছে।

দেখুন প্রকৃতি কতই না উদার। আর তাই মাত্র ক’দিনের নিষ্কৃতিতে সমুদ্র ফিরে পেয়েছে তার রঙ। তার নিজের রূপ। এই নিষ্কৃতি যে সহজেই মিলেছে তা নয়। করোনা নামের ঘাতক ভাইরাস যখন মানবকুলে তার মরণ কামড় বসিয়েছে, তখন প্রকৃতির সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ ঢুকে পড়েছে ঘরে। খুব যে সচেতনতায়, তা নয়, স্রেফ আতঙ্কে। বাঁচার তীব্র বাসনায়। ভেবে বসবেন না যেন ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’- রবি ঠাকুরের উচ্চারিত সেই বাসনা থেকে এই বাঁচার তাগিদ। পৃথিবীর মানুষ এখনও বাঁচতে চায় তার ভোগ-বিলাস আর লোভ-লালসা চরিতার্থ করতেই।

এই লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাসের বাসনায় সুন্দর ধরিত্রীটিকে আমরা কোথায় নিয়ে ফেলেছি, তা আমাদের সকলেরই জানা। সে কারণে এই করোনা ভাইরাসকে কেউ কেউ প্রকৃতির শিক্ষা হিসেবেই দেখছেন। কেউ কেউ প্রকৃতির প্রতিশোধ বলতেও ছাড়ছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানী, ‘পয়জন স্প্রিং’ নামে বিশ্বখ্যাত পরিবেশবাদী বইয়ের রচয়িতা এভাগেলোস ভ্যালিয়ানাটোস তার সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বলেছেন- করোনা ভাইরাস প্যানডেমিক কোনো দুর্ঘটনা নয়। অতীতের আরও অনেক বৈশ্বিক মহামারির মতো এও প্রকৃতির এক সতর্কবার্তা, যা পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর মানুষের উপর্যুপরি ধ্বংসাত্মক আঘাতেরই ফল হিসেবে এসেছে। ‘জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ ও প্রকৃতির প্রতিশোধ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি আরও লিখেছেন- ‘প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের নির্লজ্জ আচরণ জলবায়ুকে পাল্টে দিয়েছে, বিশ্বটাকে উষ্ণতর করে তুলেছে, পৃথিবী নামক গ্রহটিকে ফেলেছে হুমকির মুখে। আর সে কারণেই প্রকৃতি (এই পৃথিবী) আজ পাল্টা জবাব দিচ্ছে।’ দ্ব্যর্থহীনভাবেই এই পরিবেশবিদ বলেছেন- ‘জলবায়ু পরিবর্তনই বুনছে এসব মহামারি রোগের বীজ।’

একই কথা বলেছেন জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচির প্রধান ইনগার এন্ডারসনও। তিনি বলেছেন, ‘অব্যাহতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতিই আমাদের কিছু বার্তা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক বিশ্বটির উপর মানবতা যে অব্যাহত চাপ প্রয়োগ করে আসছে, তাতে আজ প্রকৃতি জানান দিচ্ছে- এই মানবকুল পৃথিবী নামক গ্রহটিকে অগ্রাহ্য করে প্রকারান্তরে নিজেকেই অগ্রাহ্য করেছে।’ প্রধানসারির আরও অনেক বিজ্ঞানীর মুখেও আজ একই কথা। করোনাভাইরাসকে তারা স্পষ্ট অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন এবং বলছেন এমন ভয়ঙ্কর আরও সব জীবাণুবাহী মরণঘাতী রোগ মানবকুলে আঘাত হানার অপেক্ষায় রয়েছে। আজকের সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে ‘আগুন নিয়েই খেলছে’, বলেছেন তারা। আর মত দিয়েছেন, আবহমানকাল ধরে প্রকৃতির আচরণ এ কথাই জানান দেয় যে- মানব আচরণের ফলেই কিছু রোগ-ভোগ মানবতার ওপর বালাই হয়ে হাজির হয়।

এ কারণে ভবিষ্যতে এমন মহামারি থেকে মানবতাকে রক্ষা করতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন বন্ধ করো। চাষাবাদের নামে প্রাকৃতিক বনগুলো উজাড় করো না। খনি খুড়ে পাতাল দেশকে ঝুঁকিতে ফেলো না। আর গৃহায়নের নামে পাহাড় কেটে প্রকৃতিতে দখলদারিত্ব ফলিও না। প্ল্যাস্টিকের ভাগাড়ে পরিণত করো না নীল সমুদ্র। গ্রিন-হাউস গ্যাসে ঢেকে দিও না সুনীল আকাশ।

এটা সত্য, করোনাভাইরাস যখন প্রতিদিনই ছড়াচ্ছে, আর কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ, তখন এই ভাইরাস যাতে আর ছড়াতে না পারে সেদিকটাতেই বেশি নজর দিতে হবে। কিন্তু এই করোনাভাইরাসের মহামারিতে প্রকৃতির দেওয়া শিক্ষাটিকে গ্রহণ করে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগগুলো এখনই নিতে হবে।

সবচেয়ে বড় প্রয়োজন প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রাখা। আমরা যখন পরিবেশ ও প্রতিবেশকে বিপন্ন করি তখন মানবকুলে তার যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে বনের ও পানির প্রাণীকুলের ওপরও পড়ে তার সমান আঘাত। হয়তো একটু বেশিই পড়ে। ফলে প্রাণীকুল বেশি বিপন্ন হয়। একসময় উজাড় হয়ে যায়। তবে সবচেয় বেশি যা ঘটে তা হচ্ছে, প্রাণীকুলে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন রোগ-বালাই। ঘটে জীবাণুর বিস্তার। অনেক ক্ষেত্রেই তা মানুষের চোখের আড়ালে থাকে। কিন্তু প্রকৃতি এক নির্দয় নিরপেক্ষ বিচারকর্তা। ফলে একসময় বন্য কিংবা গৃহপালিত প্রাণীকুলের শরীর থেকে সেই সব ভাইরাস মানবদেহেও ছড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, সংক্রমনজনিত রোগগুলোর ৭৫ শতাংশই পশু-প্রাণীর শরীর থেকে মানব শরীরে বাসা বাঁধে ও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষও হয়ে পড়ে বিপন্ন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানুষ অনেক এগিয়েছে বটে। কিন্তু কখনো কখনো প্রকৃতি মানুষকে এমন কিছুর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় যে, তার কোনো প্রতিকারও মানুষের জানা থাকে না। তখন স্রেফ অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। ঠিক যেমনটা ঘটেছে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসের ক্ষেত্রে।   

প্রকৃতির আক্রোশ যতোই হোক, প্রকৃতি উদারও। ফলে সপ্তাহ না যেতেই আমরা কক্সবাজার সৈকত ঘেঁষা সমুদ্রে দেখতে পাই ডলফিনের আনাগোনা। চীনের হুবেই প্রদেশে বাতাসের মানে ইতিবাচক পরিবর্তন। সেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা গত তিনমাসে ১৪ শতাংশ কমে গেছে বলেই হিসাব দিচ্ছে নাসা। বাতাসের মানে একই ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের হিসাব দেখা যাচ্ছে স্পেনের মাদ্রিদ শহরেও। এ ছাড়াও গত তিন মাসে চীন থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমেছে ২৫ শতাংশ। গোটা বিশ্বজুড়ে এয়ারলাইন নিঃসরণও কমেছে ব্যাপক হারে। ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় ৬ কোটি ৭০ লাখ কম যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করেছে। ফলে আকাশগুলো হয়ে উঠছে আরও নীল।

এটা বলা বোকামি হবে, করোনার মহামারি আমাদের জন্য এসব ইতিবাচক দিকগুলো বয়ে এনেছে। তবে এ কথা অবশ্যই বলতে হবে- করোনার এই আঘাত আমাদের জন্য এক বড় শিক্ষা। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই পরিবেশ ও প্রাণীকুলকে সুরক্ষা দিতে হবে। তা না হলে- প্রকৃতি এমন সব ভয়াবহ শিক্ষা নিয়ে হাজির হবে যে, মানবতাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তখন আর শেষ রক্ষা হবে না। 

ঘরে থাকুন। এখনই ডলফিনের নাচ দেখতে ছুটবেন না। তবে জানালা থেকে একটু বাইরে তাকিয়ে দেখবেন কি- ঢাকার আকাশটা একটু বেশিই নীল মনে হচ্ছে না? যদি হয় তো আওড়াতেই পারেন রবি ঠাকুরকে- ‘মরিতে চাহি না এই সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

7 colleges to continue operating under UGC until new university formed

Prof AKM Elias, principal of Dhaka College, to be appointed as the administrator

44m ago