‘মাস্ক নয় খাবার চাই’
রেমা চা-বাগান বন্ধ, করোনার দিনে অনাহারে ১২০০ চা-শ্রমিক পরিবার। গত ৫ মার্চ থেকে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা চা-বাগান বন্ধ। আজ তিন সপ্তাহ ধরে এই বাগানের চা-শ্রমিকের কাজ নেই, মজুরি নেই, খাবার নেই, চিকিৎসা নেই। তারা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এখন করোনা যেন ‘মরার ওপর খড়ার ঘা’।
বাগানের চা-শ্রমিক দিপালী বাড়াইক বলেন, ‘আর্থিক সংকটের কারণে আমরা বাচ্চাদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা চিকিৎসা পাচ্ছি না। মালিক আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না।’
তিনি বললেন, ‘কেউ আমাদের করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য মাস্ক দিতে এসেছিলেন। আমি তাদের বললাম, মাস্ককের দরকার নেই। আমার পরিবারের জন্য এখন খাবার অত্যন্ত জরুরি। আমরা মাড়ভাত খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। একদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, অন্যদিকে বাড়িতে খাবার নাই। যেন মরার উপর খড়ার ঘা।’
চা-শ্রমিক অরুণ দাস পাইনকা বললেন, ‘হঠাৎ করে মালিক চা-বাগান বন্ধ করে দেওয়া আমরা সমস্যায় পড়েছি। আমাদের ১১ দফা দাবি ছিল। দাবির মধ্যে ছিল বৃষ্টির আগে আমাদের বাড়ি মেরামত, পোষ্য রেশন প্রদান। আমাদের মূল উৎসব বোনাস ও ২০১৭-২০১৮ সালের বকেয়া মজুরি শ্রমিক প্রতি ৫১০০ টাকা এখনো পাইনি।’
তিনি আরও জানান, গত ৪ মার্চ চা-শ্রমিকদের খেলার মাঠ দখল করে বাগান ব্যবস্থাপক চারা রোপণ করার চেষ্টা করলে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে বিরোধ হয়। বিরোধের জের ধরে বাগান ব্যবস্থাপক চুনারুঘাট থানায় অভিযোগ করলে ৫ মার্চ পুলিশ তদন্ত করতে বাগানে আসে। এতে ক্ষেপে যায় শ্রমিকরা। এরপর ৫ মার্চ বাগান ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
ইউপি সদস্য নির্মল দেব বলেন, ‘এ ঘটনায় বাগানের সাবেক পঞ্চায়েত মানিক দাস ও আমাকেসহ ২৫ জনকে আসামি করে বাগান কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করেছেন। একই সঙ্গে বাগান বন্ধ করে দিয়ে তারা তালা দিয়ে চলে গেছেন।’
খেলার মাঠ দখল, বকেয়া বেতন ও মামলা দিয়ে হয়রানি বন্ধের দাবিতে চা-শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বলেও জানান তিনি।
গত রোববার সকালে রেমা চা-বাগান থেকে প্রায় ১৫ মাইল রাস্তা হেঁটে উপজেলা সদরে এসে এ বিক্ষোভ করেন তারা। বিক্ষোভে অংশ নেন বিভিন্ন বাগানের ছয় শতাধিক চা-শ্রমিক।
বিক্ষোভ শেষে চা-শ্রমিকরা উপজেলা পরিষদ এলাকায় অবস্থান নিলে চুনারুঘাট থানার ওসি শেখ নাজমুল হক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান মহালদারসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের বিষয়টি সমাধান করার আশ্বাস দেন এবং ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু, আজ পর্যন্ত তারা কোন সফলতা পাননি বলে অভিযোগ করেন চা-শ্রমিকরা।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আবুল হাসান বলেন, ‘তিন সপ্তাহ ধরে বাগানের চা-শ্রমিকদের কাজ নেই, হাজিরা নেই, রেশন নেই। দেশের জাতীয় দুর্যোগ করোনার সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে চা-শ্রমিকরা আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ করতে পারছে না। বাগান বন্ধের পরপরই স্থানীয় বাগান পঞ্চায়েত থেকে কিছু চাল দেওয়া হয়েছিল শ্রমিক পরিবারগুলিকে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। শ্রমিকদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে জেলা প্রশাসক তিন টন চাউল বরাদ্ধ করেছেন। কিন্তু সেই সাহায্য এখনো শ্রমিকদের হাতে এসে পৌঁছায়নি।’
চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘দাবি ছিল ২৪ মার্চের মধ্যে বন্ধ বাগান চালু করতে হবে। সমাধান না হলে ২৩টি চা বাগান একযোগে যেকোন কর্মসূচি গ্রহণ করবে। কিন্তু আজ ২৭ মার্চ, বাগানের শ্রমিকদের তথ্য থেকে জানা গেলো, বাগান খোলা হয়নি এবং খুব শীঘ্রই খোলার কোন সম্ভাবনাও তারা দেখতে পারছে না। তাহলে কি রেমা চা বাগানের ১২০০ চা-শ্রমিক অনাহারে দিন কাটাবে?’
শ্রমিকদের অভিযোগ, বাগানের বয়স্ক শ্রমিকদের অনেকে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তা নিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না।
রেমা চা-বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি তনু মুন্ডা বলেন, ‘রেমা বাগানের সব চা-শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখন খাবার দরকার। বাগানের শ্রমিকদের সামর্থ্য নেই খাবার যোগার করার।’
করোনার সময়কে মাথায় রেখেই সারা দেশের প্রগতিশীল সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদেরকে রেমা চা-বাগানের শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করেন তিনি।
চা-বাগানের মালিক মঞ্জর রহমান খান বলেন, ‘চা শ্রমিকদের হামলায় চার জন ম্যানেজারিয়াল স্টাফ আহত হয়েছেন। দুজনের অবস্থা খুবই সিরিয়াস। লং হিস্ট্রি আপনাকে এই দুই-এক মিনিটে বলা যাবে না। ৫ এপ্রিল যদি অফিস খোলে তাহলে আপনাকে জানাতে পারবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকরা কোন ঘোষণা ছাড়াই কাজ বন্ধ রেখেছে। তারা কাজে আসলেই আমরা বাগান চালু করবো।’
‘চা-শ্রমিকরা বলছেন আপনি বন্ধ করেছেন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।’
চুনারুঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কাদির লস্কর বাগান শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করেন। বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, ‘গত ৫ মার্চ বকেয়া মজুরিসহ ১১ দফা দাবিতে শ্রমিকরা রেমা বাগানের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে বৈঠক করে। সে সময় তারা একে অপরকে দোষারোপ করে এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সে সময় ম্যানেজারসহ ৪/৫ জন আহত হন। বিরোধের কারণে কর্তৃপক্ষ বাগানটি বন্ধ করে দেয়। ফলে চা শ্রমিকরা অনাহারে দিনানিপাত করছেন।’
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। একটু সময় লাগছে।’
Comments