নতুন গবেষণা

অজান্তেই অন্যের দেহে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে শিশুরা

পরিসংখ্যান বলছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে বয়স্কদের তুলনায় কম ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। এবার চীনের নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে নতুন তথ্য। চীনা একদল গবেষক বলছে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় এমনকি বাহ্যিক কোনো উপসর্গ ছাড়াই থাকতে পারে।

দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, গত সপ্তাহে দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজ এ চীনের ঝেজাং প্রদেশের করোনা আক্রান্ত শিশুদের ওপর একটি গবেষণা করা হয়েছে। আক্রান্ত ৩৬ শিশুর উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে ১০ থেকে ২৮ শতাংশ শিশু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। আক্রান্তদের মধ্যে কেবল সাত জনের হালকা শ্বাসজনিত সমস্যা দেখা গিয়েছিল।

শিশুদের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন প্রকাশিত অন্য একটি গবেষণায়ও প্রায় একই ফলাফল দেখা গেছে। উহানের ১৭১ শিশুর উপর গবেষণা করে দেখা গেছে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গই ছিল না। ১২ শতাংশ শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নিউমোনিয়া ধরা পড়লেও সংক্রমণের কোনো বাহ্যিক লক্ষণ ছিল না। 

ঝেজাংয়ের গবেষকরা বলেন, ‘আক্রান্ত শিশুদের একটি বড় অংশের মধ্যে কোনো উপসর্গ না থাকায় অনেক শিশু বিশেষজ্ঞ রোগ শনাক্ত করতে গিয়ে নানা জটিলতার মুখে পড়েছেন। উপসর্গ না থাকলেও শিশুরা ভাইরাসটি বহন করে অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারে। এটা অত্যন্ত বিপৎজনক।’

জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত চীনে মোট আক্রান্তের পাঁচ শতাংশ ছিল নিংবো ও ওয়েনজু অঞ্চলের বাসিন্দা। নিংবো ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ সেখানকার এক থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের ওপর একটি গবেষণা চালায়।

দেখা যায়, অসুস্থ শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশই গুরুতর কোনো অসুখে ভোগেনি, হালকা অসুস্থ হয়েছিল। প্রত্যেকেই ১৪ দিনের আগেই সুস্থ হয়ে ওঠে। যেসব শিশুদের মধ্যে তাৎক্ষণিক করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল তারা কেবল শুকনো কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল, গলা ব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্ট দেখা যায়নি।

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, ওই সময়ে অসুস্থ হওয়া প্রত্যেকটি শিশুর পরিবারেই অন্তত একজন করোনা আক্রান্ত সদস্য ছিল কিংবা কোনো না কোনোভাবে তারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

যেসব শিশুরা ওই শহর দুটিতে করোনার চিকিৎসা নিয়েছে, প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় তাদের মধ্যে জ্বরের তীব্রতা ও অন্যান্য উপসর্গ ছিল অনেক কম।  

এই চিত্রের সঙ্গে ২০০২ সালের সংক্রমিত হওয়া সার্স ভাইরাসের মিল পাওয়া যায়। করোনাভাইরাস গোত্রের সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ভাইরাসের মহামারির সময়েও প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা সেভাবে অসুস্থ হয়নি।

আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে করা সবগুলো গবেষণার ফলাফল বলছে, ভবিষ্যতে শিশুদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কানাডিয়ান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অ্যালসন কেলভিন ও স্কট হাল্পেরিন বলেন, ‘এ গবেষণাগুলো প্রমাণ করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে শিশুরা অসংবেদনশীল। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ সময় উপসর্গ না থাকায় অজান্তেই তারা ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারে।’

গবেষকরা বলছেন, নতুন করোনাভাইরাস শিশুদের ফুসফুসকে কম আক্রমণ করে। কিন্তু, এই ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হয়। তাই সুপ্ত অবস্থায় শিশুরা এই ভাইরাস বহন করতে পারে। অন্যদিকে, উপসর্গ না থাকায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করাও একটি চ্যালেঞ্জ।

দুই মাস লকডাউনের পর আংশিকভাবে খুলতে শুরু করেছে উহান। চীনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা চলতি মাসে ব্যাপক হারে কমেছে। সামাজিক সংক্রমণ নেই। গণপরিবহন চলাচলও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। গুয়েঝৌ, চিনহাই ও ইউনানসহ কয়েকটি প্রদেশের স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রদেশদের স্কুলগুলোও এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে ক্লাস শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিশ্বে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই চীনে স্কুল চালু হওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সেখানকার অভিভাবকদের মধ্যে।

জিয়াংসু প্রদেশের জিউ জেন বলেন, ‘চীনে এখন আক্রান্তের হার কমে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহে আমাদের শহরে নতুন কেউ আক্রান্তও হয়নি। আমার মনে হয়, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমার ১১ বছরের মেয়ে প্রতিদিন অনলাইনে ক্লাস করছে ঠিকই কিন্তু কিছুই শিখছে না। ক্লাসের সময় সে বিড়াল নিয়ে খেলতে শুরু করে। আগামী মাসে স্কুল চালু হলে খুবই ভালো হয়।’

তবে, সরকারি পরিসংখ্যান যা বলছে প্রকৃত পরিস্থিতি তেমনটা নাও হতে পারে বলে সন্দেহ আরেক অভিভাবক শেন জুয়ানের। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়টিতে অনেকগুলো স্তর আছে। এটা অনেক জটিল। তাই এখানে ফাঁকফোকর থাকতেই পারে। আমি আমার ছেলেকে এখনই স্কুলে পাঠাব না।’

মার্চের প্রথম দিকে চীনের একটি রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেটা পিছিয়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘কেবল ওই সম্মেলনের পরেই আমি আশ্বস্ত হব। যদি রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা বাড়ি থেকে বের হয়ে সম্মেলনে জড়ো হন তখনই বিশ্বাস করব যে চীন নিরাপদ। তার আগে আমি আমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাব না।’

বিশ্বে মহামারি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত স্কুল ও ডে কেয়ার না খোলার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ।

চীনা শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শিশুদের ব্যাপারে সর্তক হওয়া প্রয়োজন। আরও উন্নত গবেষণা প্রয়োজন। শিশুরা যদি সত্যিই ভাইরাসটির নীরব বাহক হয়ে থাকে তবে সেভাবেই আক্রান্ত দেশগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

Election possible a week before Ramadan next year: Yunus tells Tarique

He said it will be possible if preparations completed, sufficient progress made in reforms and judicial matters

1h ago