বাংলাদেশে এখনও হামে শিশু মরে পাহাড়ে

পার্বত্য চট্টগ্রামে হামে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি ত্রিপুরা ও ম্রো সম্প্রদায়ের নয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেন বারবার এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। নেওয়া হচ্ছে না প্রতিকারের ব্যবস্থা।
প্রত্যন্ত এলাকা রতি চন্দ্র কারবারি ত্রিপুরা পাড়ার হাম আক্রান্ত শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন বাবা। ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামে হামে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি ত্রিপুরা ও ম্রো সম্প্রদায়ের নয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেন বারবার এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। নেওয়া হচ্ছে না প্রতিকারের ব্যবস্থা।

সেখানকার পাড়া প্রধানরা অভিযোগ করেন তাদের পাড়াগুলো দুর্গম এলাকা হওয়ায় শিশুদের টিকা দেওয়ার জন্য কেউ সেখানে যান না।

রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম অরুণ ত্রিপুরা পাড়া, লুংতিয়ান ত্রিপুরা পাড়া, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার রতি চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারি পাড়া এবং লামার পুরাতন লাইলিয়া ম্রো পাড়ায় মৃত্যুর ঘটনাগুলো গত ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঘটছে। 

সর্বশেষ মৃত্যুর খবরটি আসে দীঘিনালার রতি চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারি পাড়া থেকে। যেখানে ধনিকা ত্রিপুরা নামে তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু মারা যায়।

ধনিকার শিক্ষক জানান, সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিল।

দনিকার বাবার সঙ্গে যখন কথা বলি, বারবার তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন বিনা চিকিৎসায় আমার আদরের মেয়েটিকে মরতে হলো।

এর আগে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার নয় শিশু একই রোগে আক্রান্ত হয়ে  মারা যায়।

পাহাড়ে যে নয় শিশু মারা গেছে তাদের বয়স এক থেকে এগার বছরের মধ্যে। আক্রান্ত পাড়াগুলোতে এখনও প্রায় ২০০ শিশু হামে আক্রান্ত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে।

একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, হামে আক্রান্ত শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে ফলে এখনও তারা শঙ্কামুক্ত নয়। আক্রান্তদের পাঁচ জনের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে চিকিৎসার জন্য তাদেরকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে হয়। এজন্যে সেনাবাহিনীর অভিনন্দন প্রাপ্য।

স্থানীয়দের ভাষ্য, সীতাকুণ্ডে ৯ শিশুর মৃত্যুর ওই ঘটনা থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা শিক্ষা না নেওয়ার ফল হিসেবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের আবারও এভাবে মরতে হচ্ছে।

সেখানকার একজন বলছিলেন, এভাবে শিশুদের মৃত্যুতে আমরা ক্ষুব্ধ। এ দায় রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের।

শিশু মৃত্যুর পর স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যদি যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া যেত তাহলে তাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যেত।

পাহাড়িরা মনে করেন, সরকারের স্বাস্থ্য কর্মীরা যদি টিকাদান কর্মসূচি এবং স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে জনগণের বাড়িতে পৌঁছাত তবে এতগুলো করুণ মৃত্যু দেখতে হতো না।

আক্রান্ত শিশুরা যাতে সুচিকিৎসা পায়, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম অনুন্নত, বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ একটি অঞ্চল। 

অস্বীকার করছি না যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) তে, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা, শিশু ও পাঁচ বছরের কম বয়সী মৃত্যু হার এবং মাতৃমৃত্যু অনুপাত কমিয়ে, টিকাদানের আওতায় উন্নতি এবং সংক্রামক রোগের প্রকোপ হ্রাস করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। 

তবু শান্তি চুক্তির পরও পাহাড়িদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও পুষ্টির সুরক্ষা এবং নিরাপদ পানীয় জলসহ মৌলিক আর্থ-সামাজিক অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত রয়েছে।

বিশেষ করে পাহাড়ি নারী, শিশু, প্রবীণ এবং প্রতিবন্ধীদের অবস্থা আরও খারাপ। কারণ তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়।

পাহাড়ের হাসপাতাল গুলোতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের উপস্থিতি খুবই হতাশাজনক। এরকম অনেক উপজেলার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসকরা একবারের জন্যও কর্মস্থলে না গিয়ে বেতন-ভাতা নেওয়ার অনেক নজির আছে।

অনেক উপজেলায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্য সহকারীরা হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার জন্য মাসে দু-তিনবার কর্মস্থলে গিয়ে থাকেন।

আমরা মনে করি একটি স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে যদি উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা রাখা যায় তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান অনেক সমস্যা দূর হয়ে যাবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি), যেগুলি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৫  সেপ্টেম্বর ২০১৫ এ গৃহীত হয়েছিল, সেগুলিতে ১৭টি অভীষ্টের আওতায় ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে যেখানে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র জন্য ছয়টি নির্দিষ্ট বলে উল্লেখ রয়েছে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা নিশ্চিত হতে চায় যে, তাদেরকে আর পেছনে ফেলে রাখা হবে না।

আমরা আশা করি আক্রান্ত শিশুরা সুচিকিৎসা পেয়ে শিগগির সুস্থ হয়ে উঠবে এবং পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কোনো শিশু নতুনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হবে না।

সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া:  সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

sanjoy_0006@yahoo

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago