গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেয়

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল। সময় সকাল ১১টা। সকালের নাস্তা শেষ করে এক বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করছিলেন কলেজ শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লো দখলদার পাকবাহিনীর সদস্যরা। ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাকে নিয়ে গেল বাড়ির পাশের রাস্তার ধারে। পেছনে দুটি হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। একইভাবে তার পাশে দাঁড় করানো হলো আরও ১১ জনকে। এরপর তাদের ওপর এক সঙ্গে গুলি চালায় দলখদার সেনারা। মুহূর্তেই মটিতে লুটিয়ে পড়লো স্বাধীনতাকামী সন্তানেরা। এখানেই শেষ নয়। হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলে তারা।
শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল। সময় সকাল ১১টা। সকালের নাস্তা শেষ করে এক বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করছিলেন কলেজ শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লো দখলদার পাকবাহিনীর সদস্যরা। ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাকে নিয়ে গেল বাড়ির পাশের রাস্তার ধারে। পেছনে দুটি হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। একইভাবে তার পাশে দাঁড় করানো হলো আরও ১১ জনকে। এরপর তাদের ওপর এক সঙ্গে গুলি চালায় দলখদার সেনারা। মুহূর্তেই মটিতে লুটিয়ে পড়লো স্বাধীনতাকামী সন্তানেরা। এখানেই শেষ নয়। হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলে তারা।

ঘরের ভেতর থর থর করে কাঁপছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী রওশন আরা বেগম ও একমাত্র শিশু সন্তান সাইদ আহমেদ। সেদিনের সেই ভয়াল ঘটনার বর্ণনা শুনছিলাম রওশন আরা বেগমের কাছ থেকে।

মানিকগঞ্জ জেলা শহরের গঙ্গাধরপট্টি এলাকার মরহুম নৈমুদ্দিন আহমেদের কনিষ্ঠতম সন্তান সিরাজ উদ্দিন আহমদ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের বাণিজ্য বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। স্ত্রী ও এক বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি যশোর শহরের ষষ্টিতলা পাড়ার ম্যাজিস্ট্রেট রহমত উল্লার বাসায় ভাড়া থাকতেন। দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলাতে থাকতেন তিনি। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শিশুপুত্রটিকে নিয়ে পালিয়ে এক মাস সাত দিন পর যশোর থেকে মানিকগঞ্জে ফিরে আসেন রওশন আরা।

দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের পর স্বাধীন দেশের হাল ধরেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নানা দৈন্যতা আর সংকটের মাঝেও বঙ্গবন্ধু খোঁজ নিতে ভুলেননি দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারের। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে দুই হাজার টাকার চেক পাঠিয়েছিলেন রওশন আরা বেগমের নামে। ১৯৭২ সালের ১৭ জুলাই, শেখ মুজিবে সই করা পত্রের মাধ্যমে ওই চেকের কথা জানানো হয়। সেই চেকটি পাঠানো হয় শহীদ পরিবারের সাহায্যার্থে, তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের কাছে।

ওই পত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী রওশন আরা বেগমকে শেখ মুজিব লিখেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। আমার প্রাণভরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।’

সেই সময় সিরাজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার কলেজের শিক্ষকসহ আরও যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের স্মরণে ওই কলেজ চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে খোদাই করে লেখা হয়েছে শহীদ সিরাজ উদ্দিনসহ অন্যান্যদের নাম।

রওশনারা বেগমের বয়স এখন ৬৫ বছর। আট বছর আগে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আর এক বছরের শিশুপুত্র সাইদ আহমেদের বয়স এখন ৪৯ বছর। বাবার চেহারা একেবারেই মনে নেই তার। শহীদ বুদ্ধজীবীর সন্তান হিসেবে গর্বিত তিনি।

সিরাজ উদ্দিন আহমেদের পরিবার বঙ্গবন্ধুর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কেননা, জাতির পিতা পত্র দিয়ে শহীদ পরিবারকে সহানুভূতি জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন।

কিন্তু, বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর, এই পরিবারটির খোঁজ নেয়নি কেউ। সরকার বদলের কারণে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকাতেও ওঠেনি সিরাজ উদ্দিন আহমেদের নাম। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে যে সহানুভূতি তার পরিবার পেয়েছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও অনুরূপ সহানুভূতি পরিবারটি আশা করে।

সিরাজ উদ্দিন আহমেদের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল যশোর এম এম কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এস এম ইবাদুল হক বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হয়েছেন কলেজের দুই শিক্ষক ও ছয় শিক্ষার্থী। তাদের স্মরণে কলেজ প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ ‘মূর্তিহীন চেতনায় চিরঞ্জীব’ নির্মাণ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেখানে লিপিবদ্ধ আছে প্রভাষক সিরাজ উদ্দিন ও প্রভাষক নবীন চন্দ্র ঘোষসহ কলেজের ছয় শিক্ষার্থীর নাম।’

শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমদ ১৯৫৩ সালে ভিক্টোরিয়া স্কুল (বর্তমানে মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগে ঢাকা বোর্ডে নবম স্থান অধিকার করেছিলেন। একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬৪ সালে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে। চাকরি পাওয়ার তিন বছর পর, ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। প্রথম পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রী ও এরপর এক বছরের পুত্র সন্তানকে নিয়ে যশোর শহরের ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।

শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদের পিতা ছিলেন মানিকগঞ্জ মুন্সেফ কোর্টের সেরেস্তাদার। বড়ভাই শফিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ওই কোর্টের নাজির, মেজভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর সেজভাই নূর উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার। অর্থাৎ, সে সময়ে হাতেগোনা যে কয়েকটি শিক্ষিত পরিবার ছিল, তার মধ্যে শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদের পরিবার অন্যতম।

শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহমেদের চার ভাইবোনের মধ্যে জীবিত আছেন সেজভাই নূর উদ্দিন আহমেদ। ৮৪ বছর বয়সী নূর উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে শুনলাম মেধাবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে। তার মতে, সিরাজ উদ্দিন ছিলেন স্বাধীনতাকামী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি শহীদ হন।

বাবার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত সেই এক বছরের পুত্রসন্তান সাইদ আহমেদ এখন স্বাধীনতা সংগ্রামে তার পিতার আত্মোৎসর্গের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাক্ষরিত পত্র আছে। আছে, সেই সময়ে জাতীয় গণমাধ্যমে বর্বর এই হত্যাকাণ্ডের প্রকাশিত সংবাদের কপি। কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ— যেখানে পাথরের ওপরে খোদাই করে লেখা আছে সিরাজ উদ্দিন আহমেদের নাম। আছে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়ণপত্র।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদনপত্রের ওপর ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সুপারিশও রয়েছে। এতকিছুর পর আর কী কী থাকলে সিরাজ উদ্দিন আহমেদের নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় উঠবে— এমন প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৮৪ বছর বয়সী সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী রেজিস্ট্রার নূর উদ্দিন আহমেদের দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মানিকগঞ্জ জেলা ইউনিটের কমান্ডার তোবারক হোসেন লুডু বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজ উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে জানিয়েছি। সুপারিশও করেছি যাতে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পান।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago