রেকর্ড পরিমাণ আমদানি, তবুও বাড়ছে গমের দাম
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ ৫৫ লাখ ১২ হাজার টন গম আমদানির পরেও করোনার অজুহাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে গম ও গমের তৈরি আটা, ময়দার দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
গত বছরের তুলনায় চলতি বছর গমের আমদানির পরিমাণ ৩১ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ও কমেছে মণপ্রতি প্রায় ৭০ টাকা। তবুও, নিত্য প্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দাম পাইকারি বাজারে বেড়েছে মণপ্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশে চলমান সাধারণ ছুটিকে পুঁজি করে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়েছেন আমদানিকারক ও মিল মালিকরা।
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎপাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জে গমের দাম মণপ্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে গমের আটা ও ময়দার বাজারে।
খোলা আটা ও ময়দার দাম পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে মানভেদে খোলা আটা ২৩ থেকে ২৭ টাকা এবং ময়দা ৩৪ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণ মানুষের চাহিদা বাড়তে থাকায় আমদানিকারক ও মিল মালিকরা বাজারে গম, আটা ও ময়দার সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এসব পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।
রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত পাঁচ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশে গম আমদানি হয়েছে ৫৫ লাখ ১২ হাজার টন। যদিও গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১২ মাসে গম আমদানি হয়েছিল ৫০ লাখ ১২ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫১ লাখ ২০ হাজার টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৪৯ হাজার টন এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৩৭ লাখ ৩৫ হাজার টন।
চলতি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি হওয়ার পাশাপাশি গত বছরের তুলনায় আমদানি ব্যয়ও কমেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা মূল্যের ২৩ লাখ ৪২ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে। ২০১৯ সালে একই সময়ে ৩ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা মূল্যের ১৬ লাখ ৩৯ হাজার টন গম আমদানি হয়েছিল।
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত এ পণ্যটি চলতি বছরে টন প্রতি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৪৮০ টাকা। যদিও গত বছর একই সময়ে পণ্যটির টন প্রতি গড়ে ২৩ হাজার ২২০ টাকা দরে আমদানি হয়েছিল। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে টন প্রতি আমদানি ব্যয় ১৭৪০ টাকা কম হওয়ায় বর্তমানে পণ্যটির দাম বাড়াকে অযৌক্তিক বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
আমদানিকৃত গমের সিংগভাগ চালানই আমদানি হয়েছে কানাডা, রাশিয়া, ইউক্রেন, আর্জেন্টিনা, ভারত ও ইতালি থেকে। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্য হওয়ায় এটি আমদানিতে কোন শুল্ক দিতে হয় না।
খাতুনগঞ্জের গমের ব্রোকার ব্যবসায়ী মো. ইমরান হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন মিলে ডিও ব্যবসায়ীরা গম সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু, গত কয়েক দিন ধরে খাতুনগঞ্জে গমের সংকট আছে বলে দাবি করছে আমদানিকারকরা। এতে গমের দাম মণপ্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকা বেড়েছে। চাহিদা থাকায় মিলগুলো বাড়তি দামে গম কিনে আটা ও ময়দা তৈরি করছে। তাই তারাও বাড়তি দাম যোগ করে আমাদের কাছে বিক্রি করছে। ফলে খুচরা ও পাইকারি বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।’
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, খাতুনগঞ্জে গত শুক্রবার মণপ্রতি কানাডার গম বিক্রি হয়েছে এক হাজার ১০০ টাকা দরে। এছাড়া রাশিয়া থেকে আমদানি করা গম মানভেদে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৯০০ টাকায়। যা গত এক সপ্তাহ আগেও যথাক্রমে ৬০ ও ৮০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছিল।
গমের দাম বাড়ায় গম থেকে তৈরি খোলা আটা ও ময়দার পাশাপাশি প্যাকেটজাত এসব পণ্যের দামও বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ফ্লাওয়ার মিল মালিকরা জানান, দেশের বাজারে হঠাৎ করেই গমের চাহিদা বেড়েছে। এটিকে কাজে লাগিয়ে কিছু আমদানিকারক মণপ্রতি ৮০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। ফলে এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। এছাড়াও দেশে চলমান সাধারণ ছুটির কারণে কিছু কারখানা বন্ধ থাকায় আটা ও ময়দার কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে।
রাশিয়া ও কানাডা থেকে নিয়মিত গম আমদানি করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আহমেদ আলী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সম্প্রতি সাধারণ ছুটির সময় বন্দর থেকে পণ্য খালাসে কিছু জটিলতার কারণে দাম কিছুটা বেড়েছে। তাছাড়া চাহিদা বেশি থাকায় দামও একটু বেড়েছে।’
কিন্তু, বিশ্ববাজারেও গমের দাম নিন্মমুখী আছে।
ইনডেক্স মুন্ডির তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে গমের টনপ্রতি দাম ছিল ২২৪ ডলার ৫০ সেন্ট। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে দাম কমে ২১৫ ডলার ৩২ সেন্টে নেমে আসে। যদিও গত বছরের একই সময়ে দাম ছিল ২২৩ থেকে ২৩০ ডলারের মধ্যে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দেশের সাধারণ নিন্মবিত্ত মানুষ আপদকালীন সময়ে আটার উপর নির্ভরশীল থাকেন। দেশে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত আটা-ময়দা বিক্রি হলেও খোলা আটা-ময়দা উপরই ভরসা গরীব ও শ্রমজীবী মানুষের। বর্তমান সংকটকালীন সময়ে আটা ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপদে আছেন এসব মানুষ। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা না হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।’
Comments