‘মরে গেলে বেঁচে গেলাম, বেঁচে থাকলে খাব কী’

ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র ব্রিজে পায়ে হেঁটে ঢাকা অভিমুখে রওনা দেওয়া মানুষের ঢল। ছবি: স্টার

সরকারিভাবেই যেখানে ১১ তারিখ পর্যন্ত ছুটি (লকডাউন) বাড়ানো হয়েছে এবং এই সময় পর্যন্ত সব গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে এই বিপদের মধ্যে পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত এবং কাজে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষের পায়ে হেঁটে, ট্রাকে কিংবা যে যেভাবে পেরেছেন দলে দলে ঢাকামুখী হওয়ার দৃশ্য এরই মধ্যে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, যখন সবকিছু বন্ধ, তখন কেন পোশাক কারখানা খুলতে হবে এবং কেন লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হবে? প্রশ্ন উঠেছে, মালিকরা যদি শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তারা কেন সরকারের কাছে প্রণোদনার প্রত্যাশা করেন বা সরকার কেন জনগণের টাকায় তাদের সেই প্রণোদনা দেবে?

করোনাভাইরাসের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক পরিণতি নিয়ে উদ্বেগে আত্মহত্যা করেছেন জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী টমাস শেফার (বিবিসি, ২৯ মার্চ)। করোনার কারণে বাংলাদেশের সব খাতই, বিশেষ করে রপ্তানিনির্ভর শিল্প যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হবে—সে বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। এরকম পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন-বিজিএমেএ’র সভাপতি রুবানা হক ডয়েচেভেলেকে বলেছেন, অর্ডার বাতিল হলেও শ্রমিকরা বেতন পাবেন। এর আগে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বিজিএমইএর বরাত দিয়ে করোনা সংকটে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ পোশাক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন বলে যে সংবাদ প্রকাশ করে, সে বিষয়ে রুবানা হক বলেন, কোনো শ্রমিক চাকরি হারাননি। লেঅফ করা হয়েছে। অর্ডার বাতিল হওয়ায় কারণে কাজ না থাকায় কিছু কারখানা লেঅফ করতে বাধ্য হয়েছে।

অস্বীকারের উপায় নেই যে, দেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক খাতের ভূমিকা বিরাট। গ্রামের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী এই খাতে কাজ করে সংসার চালান। তাদের জীবনমান কতটা উন্নত হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অন্তত খেয়ে পরে যে এই পরিবারগুলো বেঁচে থাকতে পারছে, সেটিও বাংলাদেশের মতো একটি অতি ঘনবসতিপূর্ণ এবং তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশের জন্য কম কথা নয়। সেজন্য পোশাক কারখানার মালিকরা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, করোনাভাইরাসের কারণে যখন সারা বিশ্বই বলতে গেলে লকডাউন বা অচল; যখন জরুরি সেবা সংস্থাগুলো ছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানই বন্ধ, তখন পোশাক কারখানার মতো একটি অতি সংবেদনশীল স্থান—যেখানে একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ কাছাকাছি বসে ও দাঁড়িয়ে কাজ করেন এবং যখন করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান অস্ত্রই হচ্ছে শারীরিক দূরত্ব—তখন একসঙ্গে অনেক লোক এক জায়গায় বসে কাজ করতে হয়—এমন একটি কর্মক্ষেত্রে কেন খোলার সিদ্ধান্ত হলো? এটি কি আত্মঘাতী নয়?

যে শ্রমিকরা সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরই দলে দলে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কতজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত লোকের সংস্পর্শে এসেছেন এবং এরই মধ্যে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন—তার তো কোনো হিসাব নেই। এই লোকগুলোর মধ্যে যদি ১০ জনও আক্রান্ত হন তাহলে একসঙ্গে, এক ছাদের নিচের কাজ করতে গিয়ে তাদের মাধ্যমে কত হাজার লোক আক্রান্ত হবেন? যদি দলে দলে লোকজন আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়া শুরু করেন, সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কি কারো পক্ষে সম্ভব হবে? এই ঘটনায় একজন শ্রমিক বা তার পরিবারের সদস্যেরও যদি মৃত্যু হয়, সেই দায়ভার কি পোশাক কারখানা মালিকরা এড়াতে পারবেন? সরকারও কি সেই দায় এড়াতে পারবে? কেননা, কারখানায় কাজে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ যে ছুটে এসেছেন, সেই দৃশ্য সরকারের নীতিনির্ধারকরাও দেখেছেন। দেখার পরে সরকারের তরফে এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তার মানে কারখানা খোলার বিষয়ে তাদেরও সম্মতি আছে।

প্রশ্ন হলো, কী ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা কারখানায় নিশ্চিত করা হয়েছে? কিছু যে নেই তার বড় প্রমাণ, এই যে হাজার হাজার বা লাখো শ্রমিক দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় আসবেন, সেটি তো মালিকরা জানতেন। যদি তাদের একান্তই আনতে হয় এবং যেহেতু সব গণপরিবহন বন্ধ—সেক্ষেত্রে মালিকরা তাদের জন্য বিশেষ যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারতেন। যে মালিকরা শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপদে তার শ্রমিকদের আনার কোনো ব্যবস্থা করেননি, তারা কারখানার ভেতরে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য কতটুকু কী করবেন—তা সহজেই অনুমেয়।

কারখানা মালিকদের তরফে একটি যুক্তি আছে যে, পোশাক কারখানা বন্ধ করা হয়েছে গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণার পরে। সুতরাং এই সুযোগে শ্রমিকদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার দায়িত্ব তারা নেবেন না। একটি পত্রিকাকে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, ‘শ্রমিকরা যেভাবে গ্রামে গেছে, সেভাবেই তাদের ফিরে আসতে হবে। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার দায় বিজিএমইএ নেবে না। কাজ করবে না, আবার হাজিরাও উঠবে এটা তো হতে পারে না।’

তবে মালিকদের যুক্তি যাই থাকুক না কেন, সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক। দেশের শিল্পকারখানা চালু না হলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই উৎপাদন নিশ্চয়ই উৎপাদকের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে নয়।

এই আলোচনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে তা হলো, শ্রমজীবী মানুষের জীবনের চেয়েও তাদের জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে পোশাক কারখানার মতো যেসব প্রতিষ্ঠানে ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ পদ্ধতিতে শ্রমিকরা কাজ করেন, যেখানে একদিন কাজ না করলে মাইনে কাটা, সেখানে করোনাভাইরাসের চেয়েও তাদের কাছে আসলে এই রুটি-রুজি বা জীবিকার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এবং এই অনিশ্চয়তা বা চাকরিভীতিটা যে কত ভয়াবহ, তা ময়মনসিংহ বা নেত্রকোণার মতো জেলা থেকে ঢাকার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা দেওয়ার ঘটনাতেই স্পষ্ট। সাধারণ এই মানুষগুলোর ভাবনাটা এরকম যে, মরে গেলে তো বেঁচেই গেলাম; কিন্তু বেঁচে থাকলে কী খাব? সেই ‘কী করব আর কী খাব’র উত্তর যেহেতু রাষ্ট্র তাকে দেয় না, ফলে মালিক যখন তাদের বলে যে কাজে যোগ দাও, তখন তাদের পাল্টা প্রশ্ন করবার অবকাশ বা বাস্তবতা তৈরি হয় না যে, তারা গণপরিবহন বন্ধের কালে কীভাবে ঢাকায় আসবেন বা তাদের পক্ষে এই প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই যে, আপনারা সারা বছর যে শ্রমিকের ঘামের বিনিময়ে ডলার উপার্জন করেন, সেই শ্রমিকদের কেন এই দুঃসময়ে দুই মাস সবেতন ছুটি দিতে পারবেন না?

ফলে আমাদের এখন পোশাক কারখানা খুলবে কি খুলবেন না কিংবা সেখানে শ্রমিকরা এক শ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এলেন নাকি ট্রাকের ছাদে দাঁড়িয়ে; করোনার হাত থেকে বাঁচতে কারখানার ভেতরে কী ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে—তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কাছাকাছি এসে আমরা কী ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছি? কেন এতদিনেও দেশের অধিকাংশ বেসরকারি পেশায় পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির মতো আর্থিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা গেল না? যে গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এবং যে সংবাদকর্মীরা সারা দেশের ও সারা বিশ্বের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন, সেই সংবাদকর্মীদের আর্থিক নিশ্চয়তাই বা কোথায়? তাদের মানবাধিকার নিয়ে কে কথা বলবে? সুতরাং শুধু পোশাক শ্রমিক নয়, এই দুঃসময়ে যেসব পেশার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের অন্যতম। কিন্তু যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, মালিক কি তাদের এজন্য ঝুঁকিভাতা দিচ্ছেন? নাকি করোনাভাইরাসের অজুহাতে বেতন অনিয়মিত করে দেবেন এবং লোক ছাঁটাই করবেন? কেননা এরকম ঘটনা এরই মধ্যে ঘটছে।

সুতরাং শুধু পোশাক শ্রমিক কিংবা গণমাধ্যমকর্মী নয়, সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য পেনশনসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা এবং সামগ্রিকভাবে এমন একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের কথাবার্তা শুরু করা উচিত, যেখানে চিকিৎসা-শিক্ষা-বিনোদন না হলেও, অন্তত নাগরিকের খাওয়া-পরার দায়িত্বটা রাষ্ট্র নিতে পারবে। অন্তত কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে বা কাজ না থাকলেও তাকে না খেয়ে থাকতে হবে না—এই নিশ্চয়তাটুকু যদি রাষ্ট্র দিতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে, তার রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথ এখনও ঢের বাকি।

 

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

41m ago